জাল-জালিয়াতি চক্রের সদর দপ্তর গাজীপুরের ‘জোড় পুকুর’, আছে ‘ভূয়া এসি ল্যান্ডও’!
বিশেষ প্রতিনিধি : গাজীপুরে বন ও জলাভূমি, ভাওয়াল রাজ এস্টেট এবং ‘ক’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি ছাড়াও রয়েছে বিপুল পরিমাণের খাস জমি। এসব সরকারি জমি আত্মসাত করতে সক্রিয় রয়েছে একটি চিহ্নিত জালিয়াত চক্র। এই চক্রের মূল হোতা আব্দুল হান্নান ওরফে হান্নান মোল্লা জাল-জালিয়াতির ঘটনায় ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হলেও থেমে নেই তার অপকর্ম।
সাধারণ জমির মালিকরাও ভুগছেন হান্নান আতঙ্কে।
অভিযোগ রয়েছে, ভূমি অফিসে নামজারি জমাভাগের (মিউটেশন/খারিজ) নথি অনুমোদন ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল নিবন্ধনের জন্য যেসকল কর্মকর্তার সীল-স্বাক্ষর প্রয়োজন হয় সবই আছে এই চক্রের কাছে। এই জাল-জালিয়াতি চক্রের চক্রের সদর দপ্তর গাজীপুর শহরের জোড় পুকুর এলাকায় হান্নান মোল্লার বাড়িতেই।
এই আস্তানায় (সদর দপ্তর) অভিযান চালালে জাল-জালিয়াতি সংক্রান্তে বহু তথ্য উপাত্ত ও নকল সীলমোহরসহ অনেক কিছুই মিলবে বলে ভুক্তভোগীরা দাবী করেছেন।
সহকারী কমিশনার, ভূমি (এসি ল্যান্ড) এর স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ইতিপূর্বে আব্দুল হান্নান গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খাটেন। ওই ঘটনার পর তিনি এলাকায় ‘ভূয়া এসি ল্যান্ড’ খেতাব পায়।
জেলা ও মহানগরের প্রত্যেকটি ভূমি অফিস, উপজেলা ও সার্কেল ভূমি অফিস, জেলা রেজিস্ট্রার ও জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুম এলাকায় হান্নান চক্রের বেশি বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। ভূমি অফিস ও রেকর্ডরুম কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রীতিমত এই জালিয়াত চক্রের আতঙ্কে থাকেন। অসৎ কর্মচারীদের ম্যানেজ করে অথবা নানা অপকৌশলে রেকর্ডরুমে রক্ষিত বিভিন্ন বলিয়মের পাতা কাটা, ছেঁড়া, সংযোজন, টেম্পারিং বা ঘষামাজার মাধ্যমে রেকর্ডে পরিবর্তন ঘটানোর দুঃসাহসিক কাজেও এরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চক্রের ব্যাপক অপতৎপরতার কারণে সরকারি সম্পত্তি ছাড়াও নিরীহ সাধারণ মানুষের সম্পত্তি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগীদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এদের জাল-জালিয়াতির আরো ব্যাপক চিত্র মিলবে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।
ভূমি অফিসগুলোর একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগীরা তদবির বাণিজ্যে সফল না হলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাদের অন্যায় তদবির রক্ষা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় মিথ্যা ও কাল্পনিক সংবাদ প্রকাশ করে হয়রানি করা হয়। এমনকি মিথ্যা অভিযোগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যাটাসে মন্তব্যের স্থলে ভূমি বা রাজস্ব কর্মকর্তাদের নামে আজগুবি অভিযোগ ও মিথ্যা সংবাদ কাটিং জুড়ে দেয়া হয়। এসব ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় পুলিশ আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুর সদর এসি ল্যান্ড অফিসের একজন কর্মচারী জানান, আব্দুল হান্নানের স্ত্রী গাজীপুর সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের এমএলএসএস বা অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন। জাল-জালিয়াতি ও তদবির বাণিজ্যে আব্দুল হান্নান তার স্ত্রীকে ব্যবহার করতেন। স্বামীকে জাল-জালিয়াতি ও তদবির বাণিজ্যে সহায়তা করার অভিযোগে সম্প্রতি তাকে কালিয়াকৈর উপজেলার মোথাজুড়ি ভূমি অফিসে বদলি করা হয়।
নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এবং বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের স্বাক্ষর জাল করারও অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে। আব্দুল হান্নান নিজেও একাধিক মামলার বাদী। এমনকি চুক্তিতে মামলা কিনে নিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে মামলা পরিচালনা করেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দেওয়ানী মামলা ছাড়াও জাল-জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক ফৌজদারী মামলাও রয়েছে। এসব ঘটনায় তিনি ইতিপূর্বে একাধিকবার সংবাদপত্রের শিরোনামও হয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই থেমে নেই তার এসব অপকর্ম। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে পূর্বের ন্যয় নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন একই অপকর্ম। মিথ্যা অভিযোগে হয়রানির ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না।
এব্যাপারে গাজীপুর সদর এসি ল্যান্ড অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আলোচিত আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ভূমি অফিসগুলো দালালমুক্ত করার জন্য যখনই তৎপর হন তখনই এই চক্রটি তাদের (কর্মকর্তাদের) বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। সম্প্রতি গাজীপুর শহরে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ‘ক’ তফসিলভুক্ত একটি অর্পিত সম্পত্তি জাল দলিলের মাধ্যমে আত্মসাত চেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ায় চক্রটি জেলা ভূমি বা রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল হান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব তথ্যের কোন অস্তিত্ব নেই। তার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যা ও কাল্পনিক বলেও তিনি দাবী করেন।