গাজীপুর

লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছায় দৃষ্টিহীন নাসিমা এইচএসসি পরীক্ষার টেবিলে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : এখনো পৃথিবীর আলো দেখা হয়নি নাসিমা আক্তারের। তবে অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে জ্বালিয়ে চলছেন জ্ঞানের আলো। প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র সার্টিফিকেট এবং সবশেষ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। উচ্চশিক্ষার আশায় শ্রীপুর উপজেলার পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে সোমবার থেকে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন দৃষ্টিহীন নাসিমা। এদিন শ্রুতিলেখকের সাহায্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে।

কেন্দ্রটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, প্রথম দিন সে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে শ্রুতিলেখকের সুযোগ দেয়া দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার বলেন, নাসিমা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার একটি উদাহরণ। সে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পাঠদানে অংশ নিয়েছে। যদিও তার জন্য আলাদা শিক্ষা পদ্ধতি ছিল। তার অদম্য ইচ্ছার কারণে সে লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে।

সময়টা ২০০৪ সাল। বাবা বারেক মিয়া ও মা ফিরোজা বেগম এলাকার কিছু লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের দৃষ্টি ফেরার আশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কেল্লার মাজারের বাৎসরিক ওরসে নিয়ে যান তার দৃষ্টিহীন শিশু কন্যা নাসিমা আক্তারকে। ভাল গান গাইতে পারে জেনে সেখানে উপস্থিত কিছু লোকের অনুরোধে গান ধরেন শিশু কন্যা নাসিমা, গানের সুর শুনে উপস্থিত মানুষের ছোট্ট একটি জটলা তৈরি হয়।

এদের মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন মঞ্জু সমাদ্দার নামে এক ভদ্রলোক। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন দৃষ্টিহীন নাসিমার প্রতিভা ধরা দেয় তার কাছে। দৃষ্টিহীন নাসিমাকে পড়ালেখা করানো জন্য ঢাকার একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব দেন বাবা বারেক মিয়াকে। প্রস্তাবে অবাক হন বারেক মিয়া। দৃষ্টিহীনরা কী পড়তে পারে! বাড়িতে এসে সংসারের অভাব ও দারিদ্রতা কথা চিন্তা করে দৃষ্টিহীন নাসিমাকে তুলে দেন মঞ্জু সমাদ্দারের হাতে। তাকে ঢাকার একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করান। শুরু হয় নাসিমার আলোকিত জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

এক ভাই, দুই বোন, বাবা ও মাকে নিয়ে নাসিমাদের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘী গ্রামে। বাবা এক সময় কাঁচামাল বিক্রির ব্যবসা করলেও এখন আর কাজ করতে পারেন না। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের লেখা করাচ্ছেন। আর নাসিমার ভর্তির পর তাকে কলেজের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা করেছেন কলেজের শিক্ষকরা। আর সহপাঠীরা নাসিমাকে বাড়ি থেকে কলেজে আনা নেওয়ায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই রেডিও টেলিভিশনে গানের শব্দ হলে থেমে যেতো নাসিমা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের প্রতি আসক্তি আরো বেড়ে যায়, শুরু হয় গান গাওয়া। অভাব আর দারিদ্র্যতার কারণে কোনো ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নিতে পারেনি। শুনে শুনে গান গায় সে। স্কুল প্রতিযোগিতায় দুই বার গান গেয়ে সেরা পুরস্কার জেতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে দৃষ্টিহীন নাসিমার। এখন তার গানের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়।

দেশাত্মবোধক, নজরুলগীতি, রবীন্দ্র সংগীতে রয়েছে তার ব্যাপক আগ্রহ। কারো সহযোগিতা পেলে গানের কোনো ওস্তাদের নিকট তালিম নিতে চায় সে।

নাসিমার মনের ভিতর শুরু হয়েছে স্বপ্নের বীজ বোনা। তার মনের লালিত স্বপ্ন অনুযায়ী সে লেখাপড়া করে আইনজীবী পেশাকে বেছে নিতে চায়। এলাকার অসহায় মানুষ যারা আইনের সহযোগিতা থেকে দূরে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে একজন দৃষ্টিহীন হিসেবে এ পেশাকে জয় করতে চান।

নাসিমার বাবা বারেক মিয়া বলেন, সে মায়ের গর্ভ থেকেই দৃষ্টিহীন হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। পরে সংসারের অভাব ও দারিদ্র্যতার কারণে তাকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। তবে নাসিমা ছোটকাল থেকেই খুবই মেধাবী। একটি বিষয় একবার শুনলেই সে স্মরণ রাখতে পারে। আগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে নাসিমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও এখন তাকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছি।

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, সারাদেশে স্কুল পর্যায়ে যখন বিনামূল্যে বই বিতরণ আনন্দ একযোগে উপভোগ করে তখন দৃষ্টিহীন নাসিমারা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নাসিমা খুবই মেধাবী, পড়াশোনার প্রতি তার প্রচুর আগ্রহ।

তবে শ্রেণিকক্ষের বাইরে পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকায় পুরোপুরি ক্লাসে শিক্ষকদের পাঠদানের উপর নির্ভর করতে হয়েছে তাকে। কলেজের পক্ষ থেকে নাসিমার ক্লাস ও মাসিক পরীক্ষার জন্য শ্রুতি লেখকের ব্যবস্থা সব সময় করা হয়েছে

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ একেএম আবুল খায়ের বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি নাসিমাকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সে প্রতিদিনই কলেজে নিয়মিতভাবে পাঠদানে অংশ নেয়। শিক্ষাবোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি সে ভাল ফলাফল করবে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button