বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়ক: বাস মালিকদের চাপেই কি পিছিয়ে যাচ্ছে বিআরটি প্রকল্প?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কগুলোর একটি বিমানবন্দর-গাজীপুর। যাতায়াত সহজ করতে এ সড়কে বাসের জন্য পৃথক লেন (বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি) তৈরি করছে সরকার। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ যখন নির্ধারিত মেয়াদের আগেই শেষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তখন ছয় বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে এ প্রকল্পের কাজ। পরামর্শক নিয়োগ, নকশা প্রণয়ন, দরপত্র আহ্বান থেকে ভৌত কাজ—ধীরগতি সবখানেই। এতে পিছিয়ে যাচ্ছে বিআরটি। বাস মালিকদের চাপকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে পরিবহন মালিকরা বলছেন, সরকারের ভালো কাজকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে।
২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কে নির্মাণ করা হচ্ছে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন। এই লেন দিয়ে চলবে শতাধিক আর্টিকুলেটেড বাস। বলা হচ্ছে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দরে আসতে একটি বাসের সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। বাসগুলো পরিচালিত হবে একটি সরকারি কোম্পানির অধীনে। এজন্য ঢাকা ব্যাস র্যাপিড ট্রানজিট নামের একটি কোম্পানিও গঠন করেছে সরকার। প্রণয়ন করা হয়েছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) আইন ২০১৬। আইন অনুযায়ী, শুধু কোম্পানির বাসগুলোই বিশেষায়িত লেনটি দিয়ে চলতে পারবে। কোনো ব্যক্তিগত যানবাহন বিআরটি লেনে প্রবেশ করলে গুনতে হবে মোটা অংকের জরিমানা।
বিআরটি চালু হলে এ রুটে চলাচলকারী বাসের আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, বিআরটি নির্মাণে ধীরগতির জন্য পরিবহন মালিকদের একটা চাপ আছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। তিনি বলেন, বিআরটি চালুর পর বাস মালিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য আমরা শুরু থেকেই সোচ্চার আছি। এ করিডোরে চলাচল করা বাস মালিকদের পুনর্বাসনের জন্য একটা কমিটিও করা হয়েছে। আমি নিজে সেই কমিটিতে আছি। বিআরটি চালুর পর ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের পুনর্বাসন ও প্রয়োজনে তাদের কোম্পানির আওতায় আনারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিআরটি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয় ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর। এরপর বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেনের নকশা ও দরপত্র আহ্বানেই পেরিয়ে যায় পাঁচ বছর। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিআরটি লেন নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ।
শুরু থেকেই ধীরগতি, তার ওপর দফায় দফায় নানা কারণে কাজ বন্ধ থাকায় পিছিয়ে পড়েছে প্রকল্পটি। গত ছয় বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ২০ শতাংশ। শুরুতে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। তবে ধীরগতির কারণে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নেয়া হয়। এখন প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে কাজ শেষ হবে।
বিআরটি গাজীপুর-বিমানবন্দর প্রকল্পে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রতি ছয় মাস পর ‘সোস্যাল মনিটরিং রিপোর্ট’ প্রকাশ করে আসছে। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এতে দেখা গেছে, জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তখন পর্যন্ত সড়কের পিচ প্রশস্তকরণ ও উন্নয়নের কাজ শুরুই হয়নি। সম্প্রতি সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় গিয়ে সড়ক উন্নয়নের কাজ চলতে দেখা গেছে।
২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ড্রেন ও কালভার্ট উন্নয়নের কাজ হয়েছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ গতি পেলেও এখনো সিংহভাগ কাজ বাকি। প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি উড়াল সড়ক ও একটি ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করা হবে। এর কোনোটিরই কাজ শতাংশের হিসাবে দুই অংকে পৌঁছতে পারেনি।
গাজীপুর ও বিমানবন্দরে দুটি টার্মিনাল স্টেশন নির্মাণের কথা থাকলেও এখনো সেসব কাজ শুরুই করতে পারেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এখনো শূন্যের ঘরেই আটকে আছে বাস স্টেশন ও পথচারী পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণকাজের অগ্রগতি।
প্রকল্পের কাজে ধীরগতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় উত্তরার প্রকল্প কার্যালয়ে। সেখান থেকে জানানো হয়, অনুমোদনের পর পরামর্শক নিয়োগ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে এক বছর সময় চলে যায়। বিআরটির নকশা তৈরি ও সেটি চূড়ান্ত করতে লাগে আরো দুই বছর। বিভিন্ন প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান, প্রণয়ন ও ঠিকাদার বাছাই করতে ব্যয় হয় আরো এক বছর। প্রায় পাঁচ বছর পর প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হয়েছে। এর পরও নানা সময়ে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
বিআরটি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি। প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সানাউল হক বলেন, এ সড়কে (বিমানবন্দর-গাজীপুর) দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই যানবাহনের চাপ থাকে। এসবের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে আমরা নানা সমস্যায় পড়ছি। বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লাগছে। চলাচলকারী যানবাহনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেও বেগ পেতে হচ্ছে। বর্ষায় সমস্যাটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। সড়কের ওপর পানি জমলে সেটি না সরা পর্যন্ত কাজ করা যায় না। তবে সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আমরা তা করছিও।
২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটির কাজ করছে চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গেজুবা গ্রুপ। তত্ত্বাবধান করছে সওজ। সওজের অধীনে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ, বিআরটি লেন, ছোট উড়াল সড়ক ও বিআরটি স্টেশন নির্মাণ হবে। অন্যদিকে ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড বাস লেন, টঙ্গী সেতু সংস্কার করে আট লেনে উন্নীত করা ও ছয়টি উড়াল সড়ক নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ।
প্রকল্পের আওতায় ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথক বাস লেন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ছয়টি উড়াল সড়ক হবে, যেগুলোর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। একই প্রকল্পে টঙ্গী সেতুটি সংস্কার করে আট লেনে উন্নীত করা হবে। বিআরটি রুটটিতে সরবরাহ করা হবে ৫০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আর্টিকুলেটেড বাস। এসবের বাইরে গাজীপুরে একটি বাস ডিপো, উচ্চক্ষমতার ড্রেন, ছয়টি বাজার উন্নয়ন ও ২০ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করা হবে।
বিআরটি চালু হলে এ করিডোরে ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের পুনর্বাসন জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে এডিবির অর্থায়নে। আমি যত দূর জানি, ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের পুনর্বাসন ও প্রয়োজনে তাদের কোম্পানির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা এডিবির আছে।
সূত্র: বণিক বার্তা