ছেলেবেলার ঈদ আনন্দের স্মৃতিচারণ, সেই স্মৃতি ভুলবার নয়: ওয়াহিদুজ্জামান মানিক
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। /
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাগিদ।।”
আমার শৈশব-কৈশোরের সোনালী-রুপালি স্মৃতিতে রমজানের ঈদ
(রাব্বি যিদনী ইলমা)
মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিক : তৎকালীন ঢাকা জিলার অন্তর্গত কালীগঞ্জের অতি নিকটবর্তী ভাদার্ত্তী গ্রামে (বর্তমানের গাজীপুর জিলাধীন) আমার জন্ম — সেখানেই আমার বেড়ে উঠা। সেই গ্রামীণ পরিবেশেই আমার শৈশব, বাল্য ও কৈশোর। সেই স্মৃতিময় স্বপ্নিল পরিবেশেই আমি আমার বাল্য ও কৈশোর কালের স্কুলজীবন অতিক্রম করে এসেছিলাম আজ থেকে বহুবছর আগে। তবে সেখানকার অনেক স্মৃতিই আমাকে এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে আজ মনে পড়ে, বাল্যকালের অনেক ঘটনা, অনেক মধুর স্মৃতি। এই স্মৃতিচারণে কত না পরিচিত মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মধুর স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে আমার শৈশব-বাল্য-কৈশোরকালের রমজানের ঈদ উদযাপন।
আমি যখন অতি ছোট তখন রমজানের ঈদের অর্থ ছিল রোজার ঈদ এবং এর জন্য প্রস্তুতি চলতো পুরা রমজান মাসজুড়ে। গ্রামের সবাই রমজানের ঈদের জন্য অপেক্ষায় থাকতো। পাশেই ছিল মসলিন কটন মিলের (এমসিএম) আবাসিক এলাকা এবং ঈদের আমেজ ওই এলাকার লোকদের মধ্যেও দেখেছি। মিলের আবাসিক এলাকার অনেক সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে আমার উঠাবসা ছিল বলে রমজানের ঈদের খুশী তাদের সাথেও ভাগ করেছি।
আমাদের বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল পরিবারবিহীন একটা লম্বা কোয়ার্টার এবং সেখানে একাধিক বয়স্ক লোক থাকতেন। সেখানকার অনেকজন ছিলেন উর্দূভাসী এবং প্রতি লোককেই আমরা সবাই চিনতাম। এরমধ্যে সুদূর আজাদ কাশ্মীর নিবাসী প্রাক্তন সৈনিক প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মতো লম্বা জনাব আব্দুল গনি মিয়া নামে মিলের সিকিউরিটি বিভাগের সুপারভাইজার থাকতেন। তিনি ব্রিটিশ মিলিটারিতে আমার জ্যাঠাতো ভাই জনাব আসাদুজ্জামান ওরফে সুরুজ মিয়ার সহকর্মী ছিলেন এবং সেই সুবাদে আমাদের বাড়ির লোকজনের সাথে তিনি সুমধুর ব্যবহার করতেন। সারা রমজান মাস ধরে প্রতিদিন ইফতারের সময় তিনি নিজ হাতে তৈরী করে পথচারীদেরকে ধরে ধরে লেবু ও ইউসুগুলির ভুষি-মিশ্রিত অমৃত স্বাদের চিনির শরবত পান করাতেন এবং মাঝে মাঝে মুড়ির সঙ্গে বুট-ছোলা মিশ্রিত সুস্বাদু ইফতারী খেতে দিতেন। কে রোজা ছিলনা বা কে রোজা আছে সেই প্রশ্নের তোয়াক্কা তিনি করতেন না। আমাদের মত নেহায়েত অল্পবয়স্ক পোলাপাইনদেরকেও বাদ দিতেন না। বাড়িতে ইফতারীর সময় কিংবা ইফতির পর মাগরিবের নামাজ নিয়ে আমার বাবা ব্যাস্ত থাকলে লোকায়ে কতবার যে সেই সুস্বাদু ইফতারী খেয়েছি এবং কতদিন যে সেই অমৃত শরবত পান করেছি তার হিসাব ছিল না। সেই ইফতারি খেয়ে ও শরবত পান করে যে পরম তৃপ্তি পেতাম সেই স্মৃতি আমাকে এখনও চরমভাবে টানে। তবে মিলের ভিতরের লোকজন ঈদের নামাজ পড়তো এম.সি.এম. মসজিদে। আমার বাল্যকালে হাই স্কুলে পড়ার সময় শুক্রবারের নামাজসহ প্রায়ই আমি মিলের মসজিদে রীতিমতো নামাজ পড়তাম এবং দুই একবার আমি ঈদের নামাজও এমসিএম মসজিদে পড়েছি।
আমাদের বাড়িতে রমজান মাসে শুধু রোজা রাখা নয়, রমজান মাসের অর্থ হলো আমার বাবা মৌলভী বদরুজ্জামান মাস্টার সাহেবের স্কুল ছুটি। আমার বাবা-মা রোজা রাখতেন এবং বড় দুই বোনকেও রোজা রাখতে দেখেছি। আমার থেকে বছর চারেকের বড় আমার মেজো ভাইকে মাঝে মাঝে রোজা রাখতে দেখেছি তবে দুপুরের পরে ‘কলার ডাগ্গা’ দিয়ে তার মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যটা আমার স্মৃতিতে এখনো ভেসে উঠে। শুনেছি আমার ভাইদের মধ্যে সর্ব জ্যৈষ্ঠ ভাই রোজা রাখতেন, তবে তিনি সারাবছরই থাকতেন ঢাকায়। কারণ তিনি তখন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সাধারণত ঈদের কয়েকদিন আগে তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে আসতেন সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করার জন্য এবং আমার ছেলেবেলার সুখস্মৃতিতে বড় ভাইয়ের ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার স্মৃতি আমার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছে। ঈদের ছুটির পর যেদিন তিনি ঢাকা ফিরতেন সেদিন সবাই মিলে আড়িখোলা রেলস্টেশন থেকে তাঁকে বিদায় দিতাম।
শৈশব বা ছোটকাল কাটিয়ে যখন বাল্যকালে পৌঁছি, তখনকার রোজার ঈদের ছুটির স্মৃতি ছিল একটু অন্যরকম। পুরো রমজান মাসজুড়ে আমার বাবা আমাদের নানা বইপুস্তক পড়ে শুনাতেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল পাদ্রী লালবিহারী দের ‘ফোক টেলস অফ বেঙ্গল’ এবং তা থেকে ‘ফকিরচাঁদের’ গল্প বা ‘রাক্ষসের’ গল্প পড়ে শুনাতেন। প্রতিটি গল্পের অর্থ আবার মনোগ্রাহী বাংলা গদ্যে বলতেন। আমার মনে হয় তা ছিল ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়ার এক ধরণের প্রস্তুতি পর্ব। আবার এও হতে পারে যে আমরা যাতে মিলের মাঠে গিয়ে খেলাধুলায় মত্ত না হয়ে থাকি সেই জন্য বাড়িতে রেখে নানা বিষয়ে লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত রাখা হতো।
১৯৫৮ সালে যখন তুমুলিয়া মিশন প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন রোজার ছুটিতে তিনি আমাকে ‘ফোক টেলস অফ বেঙ্গল’ বইটি থেকে ইংরেজী গল্প পড়ে শুনাতে বলতেন। এতে আমি তাজ্জব হয়ে যাই কারণ তখন মাত্র অল্প অল্প করে কিছুটা ইংরেজী পড়তে শিখেছি। তবে ততদিনে অনেক ইংরেজী শব্দ ও বাক্য বাবার মুখে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। পিতৃআজ্ঞা পালনকল্পে প্রায় প্রতিদিনই বইটি থেকে আমাকে ইংরেজী গল্প পড়ে শুনাতে হতো এবং এই পাঠ্যাভাসের ফলশ্রুতিতে মাসখানেক পরেই আমার ইংরেজী পড়ার জড়তা কেটে যায়। তখন হঠাৎ করে ইংরেজী ভালো করে শিখবার ও বলবার আগ্রহ শতগুণ বৃদ্বি পায়।
সে সময়ই আমি নিজে নিজে পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা পড়তে শিখেছি কারণ আমার পিতা ১৯৫৪ বা ১৯৫৫ সাল থেকেই ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তৎকালীন সময়ে কালীগঞ্জের জনাব হেমায়েতউদ্দিন আহমেদ সাহেবের উদ্যোগে ১৬টি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা কালীগঞ্জে হকার মারফত নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার পিতা ও জনাব হেমায়েত সাহেব ছাড়া বাকি ১৪টি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার গ্রাহকই ছিলেন MCM-এর অফিসাররা। আমার পিতা পরের বছর রোজার ছুটিতে আমাকে মাওলানা আল্লামা ইউসুফ আলীর কোরানের ইংরেজী তর্জমা থেকে সবাইকে উচ্চস্বরে পড়ে শুনাতে বলতেন। শ্রোতার অভাব ছিল না। বিনাবাক্যে আমি তাই করতাম কারণ আমার বাবা ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তখন থেকে প্রতি রোজার মাসেই আমার পিতা আমাদেরকে নানারকম পদ্বতি অবলম্বন করে লেখাপড়ায় ব্যাতিব্যাস্ত করে রাখতেন। আমি তখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম যে তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস বোধকরি কারোর ছিলো না।
রমজান মাস শুরুর পূর্বেই আমার মা নিজ হাতে প্রচুর পরিমানে চাউল ভেজে মুড়ি তৈরী করতেন এবং তা একাধিক টিনে ভরে রাখতেন যাতে পুরা রমজানের ইফতারীতে ব্যবহার করা যায়। সুগৃহিনী আমার মা রমজান মাসের একটু আগেই পরিমান মতো ছোলা, পিয়াজ ও রসুন কিনে আনাতেন। এই কাজগুলি আমার মেজো ভাই অতি আগ্রহের সাথেই করতেন।
পবিত্র রমজান মাসজুড়ে আমার মা ব্যস্ত থাকতেন সুষ্ঠভাবে ঈদুলফিতর উদযাপন করার প্রস্তুতির জন্য। রোজার ঈদের প্রস্তুতি ছাড়াও প্রতিদিনের সেহরি ও ইফতারের তৈরির জন্য আমার মাকে অনেক সময় দিতে হতো এবং নিজের হাতেই তিনি ইফতারি বানাতেন। ইফতারীর সাথে প্রায়ই লেবুর শরবত থাকতো কারণ তখন বাড়ি ভর্তি লেবু গাছ ছিল। ছোটদের মধ্যে আমরা যারা বে-রোজদার ছিলাম (এর মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম) তাদের জন্য সকালে ও দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আমার মা নিজে করতেন। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম এবং আমাদের সংসারটা মোটেই ছোট ছিল না। তৎকালীন সময়ে মাঝে মাঝে মেহমানও থাকতেন। আমার মাকে সংসারের নানাবিধ কাজে সাহায্য করার লোক থাকা সত্ত্বেও ভাতসহ সবধরণের মাছ ও তরিতরকারী আমার মা নিজের হাতেই পাক করতেন।
১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন হাই স্কুলের শিক্ষকের গৃহিনী হিসেবে–বিশেষকরে আমার পিতা যখন জামালপুর হাই স্কুলে হেডমাস্টারী করতেন (১৯৫৫-১৯৫৬ সালে), একথা বলতে আমার কোনোপ্রকার দ্বিধা নেই যে আমার মা সবসময়ই আর্থিক টানাপোড়নে থাকতেন। কারণ ততদিনে MCM-এর জমি অধিগ্রহনের জন্য আমার বাবা যে টাকা পেয়েছিলেন তা প্রায় নিঃশেষ হতে যাচ্ছিলো। তবে পুরা রোজার মাসের উন্নতমানের খাবারের ও দৈনিক মুখরোচক ইফতারীর আয়োজন দেখে সংসারের তখনকার আর্থিক টানাটানি অনুধাবন করার কোনো উপায় ছিল না।ছোট বলে আমরা যারা রীতিমতো রোজা থাকতাম না, তারাও পর্যাপ্ত পরিমানে ইফতারী খাওয়ার ব্যাপারে অবহেলা দেখাইনি।
১৯৫৭ সালে আমার বাবা যখন নরসিংদীর সাটিরপাড়া কালীকুমার ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা শুরু করেন তখন থেকে তুলনামূলকভাবে আমাদের সংসারের আর্থিক অসচ্ছলতা কিছুটা কেটে যাওয়ার ফলে রোজার ঈদের সময় আনন্দ উৎসব একটু ভালো করেই উদযাপিত হতো। তবে আমার মায়ের কড়া নজর ছিল খাওয়া-দাওয়ার মানটি উন্নত রাখা –রোজার মাস হউক বা অন্য কোনো মাস হউক।
আমাদের বাড়িতে রোজার মাস মানে পুরো রমজান মাস ধরে নানারকম নকশি করা পিঠা তৈরির কাজ নিয়ে আমার মাকে ব্যাস্ত থাকতে দেখা। আমার মা বিভিন্ন পিঠা (পাতা পিঠা ও ফুল পিঠা), জুড়ি ও হাত সেমাই নিজ হাতে অতি পারদর্শিতার সঙ্গে তৈরী করতেন। পাতা পিঠা তৈরী করা ছিল অতি সহজ কাজ। পরে বুঝেছি যে এসব পাতা পিঠা রৌদ্রে শুকানোর ও পরে সরিষার তেলে ভাঁজার জন্যও সুন্দর কৌশল ব্যাবহার করা হতো। তবে ঈদের জন্য একধরণের নকশি করা ‘ফুল পিঠা’ তৈরিতে ছিল আমার মায়ের পারদর্শিতা। তখনকার দিনে ঢেঁকিতে আওলা (অসিদ্ব) চাউলের গুড়ি করে ফুল পিঠা তৈরির জন্য তৎকালীন সময়ে পরিমিত আদ্রতা রেখে গুড়ির ‘কাই’ তৈরী করাও খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। এই ‘কাই” করার কাজ করা হতো ‘কাহাইল’ ও ‘ছেহাইট’ ব্যবহার করে এবং এসব কাজ করার জন্য লোকের অভাব ছিলোনা। আমার এখনো মনে আছে যে আমাদের চেয়ে বড় বোন ও চাচাতো বোনরাও আমার মায়ের সাথে পিঁড়িতে বসে পিঠা বানাতেন। তবে পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও অনেকে নিজেদের বাড়ি থেকে চাউলের গুড়ি দিয়ে পিঠা তৈরীর ‘কাই’ এনে আমার মার কাছে বসে ফুল পিঠা বানানোর পদ্বতি শিখবার চেষ্টা করতেন এবং ফুল পিঠা বানায়ে তাঁরা তাঁদের বাড়ি নিয়ে যেতেন। এখনো মনে পড়ে যে প্রতিবেশীরা বাড়ি যাওয়ার সময় আমার নরম-শরম জননী বার বার তাঁদেরকে বলতেন: “কাঁচা পিঠাগুলি তেলে মোটামোটি ভাজার পর বেশ কয়েক দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। ভালো করে পিঠাগুলি শুকায়ে তা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার পর ঈদের দিন শুকনো পিঠাগুলো নুতন করে তেল দিয়ে ভেজে পরিষ্কার গুড়ের শিরায় ভিজিয়ে তুলতে হবে “।
শীতকালে রোজার ঈদ পড়লে আমাদের উঠানে বসে আমার মা ও অন্য সবাই যে যাঁর পিঠা বানাতেন। রোজার ও বকরী ঈদ উপলক্ষ্যে আমার মা ফুল পিঠা বানাতেন প্রচুর পরিমানে এবং তা তিনি যত্ন করে একাধিক টিনে ভরতেন। আমাদের মধ্যে ফুল পিঠারই চাহিদা ছিল বেশী। প্রচুর পরিমানে ফুল পিঠা বানানোর প্রধান কারণ ছিল যে আমাদের সঙ্গে আমার জ্যাঠাতো ভাইরা ও বোনরাসহ আমরা সবাই যাতে পিঠা খেতে পারি। পাঁচ যুগেরও বেশী সময় আগের সেই পুরানো সুখস্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায় এবং আমার মমতাময়ী জননীর কথা মনে করে অনেক অনুপ্রাণিত হই।
আমার বাল্যকালের রোজার ঈদের স্মৃতিতে ভাসে যে পুরো রমজান মাস জুড়ে পড়ন্ত বিকেলে আমার মায়ের সুরকরে কোরান পড়া। আমার মা ছিলেন বাংলায় লেখাপড়া জানা সুগৃহিনী। এখনো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে যে আমার মা রোজার মাসে প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে কিছূক্ষণ আমাদেরকে নিয়ে বসতেন এবং বাংলায় লিখা ‘নিয়ামুল কোরান’ থেকে পড়ে শুনাতেন। যদিও তিনি সংসারের শত কাজে ব্যস্ত থাকতেন তথাপি বিখ্যাত ‘বিষাদসিন্ধু’ থেকে আমাদের পড়ে শোনাতে সময় বের করতেন। প্রতিটি পবিত্র রমজান মাসে ও মহরমের সময় আমার মা সুর করে জোড়ে জোড়ে বিষাদ সিন্ধু থেকে পড়ে শুনাতেন এবং আমরা যারা শ্রোতা থাকতাম তারা অনুপ্রানিত হতাম। সেই স্মৃতি ভুলবার নয়।
আমার বাল্যকালে রমজানের ঈদ বলতে সাধারণতঃ নুতন কাপড়চোপড় কেনাকাটার সম্ভাবনা। কালীগঞ্জ বাজারে গিয়ে ‘রোশনা খলিফার’ দোকানে গিয়ে নুতন শার্ট বানানোর জন্য মাপ দেওয়ার কথা এখনো আমার স্মৃতিতে আছে। তবে সব বছর যে খলিফার তৈরী শার্ট পরার সৌভাগ্য হতো তা নয়। কোনো কোনো বছর বিশেষ করে ১৯৫৬ সালে রোজার ঈদে রেডিমেড বা তৈরী শার্ট হতো আমাদের জন্য বাবার দেওয়া ঈদের উপহার। এতে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্দ হতাম কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈদের ফুর্তি কম করেছি বলে মনে পড়ে না। পাড়ার অনেকেই ঈদে রেডিমেড বা তৈরী শার্ট পড়ে ঈদ করে সন্তুষ্ট ও অভ্যস্থ ছিল। তবে প্রতিবছর কাগজের নুতন টুপি পরে ঈদ উদযাপন করার সুযোগ সবসময়ই হয়েছে। কাগজের টুপি ছিল আমার অতি প্রিয় জিনিস এবং বেশ বড় হয়েও আমি কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে পছন্দ করতাম। সেই স্মৃতি আমি এখনো ভুলি নাই। তবে আরেকটা জিনিস আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে: ঈদের সময় বেশির ভাগ লোকই কোনো প্রকার নুতন জামা কাপড় কিনতে পারতনা। তখনকার দিনে কাপড়চোপড়সহ বিবিধ জিনিসপত্র খুবই সস্তা ছিল কিন্তু তার মধ্যেও আমাদের পাড়ার অনেককেই দেখেছি একই জামাকাপড় পরে বছরের পর বছর দিনাতিপাত করতে। এসব জিনিসের মর্মাথ তখন যে বুঝেছি তা নয় কিন্তু একটু বড় হয়ে কিছুটা বুঝতে শিখেছিলাম।
আমি যখন ছোট ছিলাম (১৯৫৪ থেকে ও ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত) তখন প্রতি ঈদের দিনে খুব সকালে আমার বাবা আমাদের চার ভাইকে খন্দকার বাড়ির পুকুরে নিজ হাতে লাইফবয় সাবান দিয়ে গোছল করায়ে দিতেন ও নিজেও চটকরে গোছল করে ফেলতেন। বাড়িতে ফিরেই আমার বাবা তাড়াহুড়ো করে কাপড়চোপড় পরে একদম কিছু না খেয়ে সবার আগে মীরার মসজিদে চলে যেতেন এবং আমরা কিছু সেমাই খেয়ে আরো পরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম।
আমার বাল্যকালে ঈদের নামাজ বলতে যা বুঝাতো তাহলো ভাদার্ত্তী গ্রামের “মীরার মসজিদে” গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া। পুরো উত্তর ভাদার্ত্তী গ্রামে (বাঙাল বাড়িসহ) মীরার মসজিদই একমাত্র বড় মসজিদ ছিল যেখানে গ্রামের সবাই ঈদুল ফিতর (রোজার ঈদ) ও ঈদুল আযহার (বকরি ঈদ) নামাজ পড়ত। তখন গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় মসজিদের কথা চিন্তা পর্যন্ত করার প্রশ্ন উঠতোনা। তবে ভাদার্ত্তী গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় জনাব হাশেম খলিফার বাড়ির পাশেই একটি ছোট মসজিদ ছিল এবং সেখানে শুধু দক্ষিণ পাড়ার লোকজনই নামাজ পড়ত। আমাদের গ্রাম থেকে কয়েকজন লোককে কালীগঞ্জের মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে দেখেছি। এছাড়া বলতে গেলে আমাদের গ্রামের আবালবৃদ্ব ভাদার্তীর মীরার মসজিদেই নামাজ আদায় করতেন এবং আমার এখনও মনে আছে যে ঈদের দিনে পুরো মসজিদই আঙ্গিনাসহ লোকসমাগমে ভরে যেত। তাঁদের মধ্যে বয়োজৈষ্ঠরা বহুযুগ পূর্বেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিন্তু তাঁদের মুখচ্ছবি আমার মানসগগনে এখনও অম্লান হয়ে আছে। বহুদিন আগের স্মৃতি রোমন্থন করছি। অথচ বহু বছর পূর্বের ফেলে আসা দৃশ্যাবলী কতই না স্পষ্ট। সেই দৃশ্যাবলী ভুলবার নয়। এই স্মৃতি ভুলব কেমনে?
আমাদের গ্রামের জনাব মাতব্বর বা মাতবর মীরের পিতা জনাব একাব্বর বা আকবর মীর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভাদার্তীর প্রসিদ্ব “মীরার মসজিদ” ছিল আকর্ষণীয় স্থান এবং এখানে ঈদের নামাজের পূর্ব থেকেই পুরা মসজিদটি ভিতরে-বাইরে আঙ্গিনাসহ সাজানো থাকত লাল, নীল, সাদা, সবুজ,হলুদ, ও বেগুনি কাগজের ঝালট ও নিশান দিয়ে। প্রতিটি ঈদে বেশ কয়েজন যুবক ও কিশোর মিলেমিশে হাতেকাটা নানা রঙের নিশান লম্বা রশির গায়ে আঠা দিয়ে জড়িয়ে মসজিদের দুই পাশে এবং সামনের আঙ্গিনা ঘিরে টানিয়ে দিত। মসজিদের ভিতরে ও বারান্দায় রঙিন ঝালটা লাগানো হতো। এ কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্বে থাকতেন উত্তর পাড়ার আব্দুল কুদ্দুস নামে এক নিবেদিতপ্রাণ যুবক এবং সারা জীবন ধরে তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি বয়সে আমার অনেক বড় ছিলেন কিন্তু সারা জীবন আমাকে তিনি মামা বলে ডাকতেন। বহুদিন ও বহু বছর হলো তিনি প্রয়াত। তবে আজও আমার হৃদয়ে তাঁর নানা রঙের নিশান দিয়ে মসজিদ সাঝানোর স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে। অনেক সময় মনে হয় সেই হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলি যেন আজও নানা রঙের “রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে” ঢাকা আছে।
আমার ছেলেবেলায় আমাদের মসজিদের ইমাম ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রখ্যাত মুন্সী বাড়ির জনাব সিরাজুদ্দীন মুন্সী এবং প্রতিবছর তিনিই আমাদের ঈদের জামায়াতে ইমামতি করতেন। তিনি পুরো ছয় ফুট লম্বা ছিলেন। তাঁর গায়ের রং ছিল কালো কিন্তু তিনি ছিলেন সাদা মনের মানুষ। তিনি যদিও মুন্সী ছিলেন তবে গ্রামে তিনি ধর্মের নামে মোটেই গোড়ামী শিক্ষা দিতেন না এবং তিনি গ্রামের আবালবৃদ্ব বণিতার সঙ্গে মিলামিশা করতেন। তিনি ছিলেন মনখোলা ও ফুর্তিবাজ মানুষ এবং তাঁকে আমি ঈদের দিনে লুঙ্গি লেংটি দিয়ে হাডুডু খেলতে দেখেছি। তাঁর ছিল মাছ ধরার বাতিক এবং পুরা বর্ষাকাল ধরে তিনি তেতুল গাছের কাছে খালে বুচুন ও ঝাল পেতে রাতদিন মাছ ধরতেন। তা ছিল আমাদের গ্রামের এক এলাহী কান্ড এবং মাছ ধরতে পারুক কিংবা না পারুক গ্রামের অনেকেই ওখানে গিয়ে ভিড় করে আড্ডা দিত ও প্রানখুলে গল্পগুজব করতো। দিনের বেলায় আমিও সেখানে বহুবার গিয়েছি এবং আমার স্মৃতিপটে মিলনমেলার ও তাঁর মাছ ধরার স্মৃতি ভেসে উঠে। একসময় তিনি আমাদের গ্রাম ছেড়ে মুন্সেফপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন এবং আমৃত্যু আমাদের গ্রামের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আমাদের গ্রামে আসলে আমার মার সাথেও তিনি মাঝে মাঝে দেখা করে যেতেন।
জনাব সিরাজুদ্দীন মুন্সী সাহেব আজ বেঁচে নেই। তবে এখনো এই মুন্সী সাহেবের প্রতি বছর দুই ঈদের জামাতে ইমামতির কথা মনে পড়ে। রোজার ঈদের সময় প্রথমে তিনি একাধিকবার ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত আরবিতে পরিষ্কার উচ্চারণে বলে দিতেন: “নাওয়াইতু-য়ান উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকয়াতাই সালাতি ঈদিল ফিতরে ,মায়া ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা ইকতাদাইতু বিহাযাল ইমাম, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার”। তারপর তিনি উচ্চ স্বরে ঈদুল ফিতরের নামাজের বাংলা নিয়ত বলে দিতেন: “আমি ইমামের পেছনে কেবলামুখি হয়ে ঈদুল ফিতরের দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায়া করছি- আল্লাহু আকবার”। নিয়ত বলে দেওয়া ছাড়াও তিনি বাংলায় সংক্ষিপ্তভাবে ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম বলে দিতেন। আজ বহু যুগ পরেও জনাব সিরাজুদ্দীন মুন্সী সাহেব যে বিশুদ্ব সুরে ঈদুলফিতরের নামাজের আরবী নিয়ত বলে দিতেন তাঁর গলার সেই চিরচেনা স্বরটি আমার কানে বাজে। সময়ের ব্যাবধানে বা স্থানের দূরত্বে তা ম্লান হয়ে যায়নি।
পবিত্র রোজার ঈদের জামায়াতে নামাজ সেরে বাড়িতে ফিরে এসে প্রথম কাজ ছিল ক্ষীর, সেমাই, ও বিভিন্ন ধরণের পিঠে খাওয়া। ঈদেরদিন খুব ভোরে ফজরের নামাজের পর আমার মা ঈদের জন্য রান্নাবান্না শুরু করতেন। আমরা ছিলাম অনেক ভাইবোন এবং ঈদের দিনে মেহমানও আসত। আমার বাবার কয়েকজন ছাত্রও ঈদের দিন দেখা করতে আসতেন এবং আমার মা তাদের কাউকে খালি মুখে যেতে দিতেন না। তাই আমার মা ঈদের জন্য যা কিছুই পাক করতেন তা তিনি বড় ডেকচিতে বা পাতিলে করতেন। এমনকি হাতে তৈরী সেমাইও যত্ন সহকারে বড় পাতিলে পাক করতেন। আর দুধ ও গুড় দিয়ে যে চাউলের ক্ষীর তৈরি করতেন তা তিনি বিরাট বড় মাটির পাতিলে অল্প জালে সময় নিয়ে তৈরী করতেন এবং কেন জানি মনে হয় সেই অমৃত ক্ষীরের স্বাদ এখনও আমার জিহ্বায় লেগে আছে।
সকালের দিকে এসব মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার তৈরীর কাজ শেষ হওয়ার পর আমার মা দুপুরের পূর্বেই পোলাও ও গরুর মাংস পাকের কাজ শুরু করে দিতেন। সাথে মুরগীর কোরমাও থাকতো। ভাগ্যের কথা যে তৎকালীন সময়ে মাংসের দাম সস্তা ছিল। কোনো কোনো বছর খাসির মাংসও পাক করা হতো। দুপুর দেড়টার পূর্বেই আমার মা খাওদাওয়া রেডি করে আমাদেরকে খাওয়াতেন।
একটু বড় হওয়ার পর আমার একটি বাতিক ছিল এই যে অন্য কাউকে সঙ্গে না নিয়ে ঈদের দিন দুপুরের খাওয়া খেতে বসতাম না। তুমলিয়া মিশন প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়বার সময় থেকে (১৯৫৭ সাল ও ১৯৫৮ সাল) আমাদের উত্তর বাড়ির শামসুল হককে প্রতিটি ঈদের দিন আমার সঙ্গে দুপুরে খেতে বলতাম। ঈদের নামাজের পর পর শত অনুরোধেও সে আমাদের বাড়িতে আসতে চাইতনা। তাকে আসবার জন্য পীড়াপীড়ি করলে শামসুল হক বলত, “আমি দুপুরের পরে আসব তোর সাথে মাংস-পোলাও খেতে”। সে ছিল খুবই লাজুক প্রকতির ছেলে কিন্তু সে অতি ভোজনপ্রিয় ছিল। এমনি যখনি সে আসতো মা তাকে খুবই সমাদর করতো এবং আমার মাকে সে দাদি বলে ডাকতো। রোজার ঈদের দিন দুপুরের একটু পরে যখন শামসুল হক আমাদের বাড়িতে আসতো তখন সঙ্গে করে সে একটা লেবু আনতো। আমার মা তার লেবুটা কেটে দিতেন এবং আমরা দুইজন আমাদের রান্না ঘরেই পিঁড়িতে বসে জলচকির উপর প্লেট রেখে ভুরিভোজ করতাম। সে স্মৃতি ভুলবার নয়।
তার কয়েক বছর পর থেকে আমাদের মধ্যে সবার চেয়ে প্রাচীন আব্দুল হান্নানও ঈদের দিনে দুপুরের খাওয়ার সাথী হতো। শামসুল হক ছিল আমার বাল্য বন্ধু এবং খেলার সাথী যদিও বয়সের দিক দিয়ে সে আমার চেয়ে বছর খানেকের বড় ছিল। শিশু শ্রেণীতে না পড়েই শামসুল হক ও আমি ১৯৫৫ সালের জানুয়ারীতে ভাদার্ত্তী ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখনও আমি নামাজকে ‘মোয়াজ’ এবং বাবার নামাজের চকিকে ‘মোয়াজের চৌকি’ বলে উচ্চারণ করতাম। তুমলিয়া প্রাইমারীতে ও কালীগঞ্জ হাই স্কুলেও আমরা এক সাথে পড়েছি। খেলাধুলায় সে ছিল চৌকষ ও লেখা-পড়ায়ও সে ছিল তুখোড়। আমার এই অকৃত্তিম বাল্যবন্ধু, অজাতশত্রূ শামসুল হকের অকাল মৃত্যু হয়েছিল ইমদু গুন্ডা নামক এক বর্বর নরপিচাশের গুলিতে। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় নি — এর একমাত্র কারণ ছিল রাজনৈতিক। বিনাদোষে বা বিনাপ্ররোচনায় এমন জঘন্য ধরণের নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। এই দুঃখ রাখবার জায়গা কোনোদিন পাইনি। শতবার কেন অযুতবার অভিযোগ করলেও অকালে প্রয়াত শামসুল হক যে আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা–এই কথা তো ভালোকরেই জানি ও বুঝি। আমার নরম-শরম মা-জননী যিনি আমার এই লম্বা ও ফর্সা বিনয়ী বাল্যবন্ধুটিকে অতি স্নেহ করতেন তিনিও আজ বেঁচে নেই। তবে শামসুল হকের সাথে ঈদ করার স্মৃতি এবং আমার বন্ধুর প্রতি আমার ধৈর্যশীলা মায়ের স্নেহমাখা সমাদরের স্মৃতি বেঁচে আছে আমার শতধা বিদীর্ণ হৃদয়ে।
রমজানের ঈদ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান বলতে ছিল বিকেলে মসলিন কটন মিলের প্রকান্ড খেলার মাঠে বিবিধ খেলাধুলার আয়োজন। শীতকালে বা বসন্ত কালে ঈদ পড়লে মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে অনেক উন্নতমানের ‘দাড়িয়াবান্ধা’ খেলার ধুম পড়ে যেত। সেই খেলার স্মৃতি এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। বর্ষা বা বৃষ্টির দিনে ঈদ পড়লে শ্যাম বেটে হাডুডু খেলা হতো–হয় ‘বিয়াস্থ’ (বিবাহিত) বনাম ‘অবিয়াস্থ’ (অবিবাহিত) না হয় উত্তর পাড়া বনাম দক্ষিণ পাড়ার খেলা হতো। অনেক সময় দেখেছি যখনই পাড়া বেটে খেলা হতো তখনিই দুই পাড়ার মধ্যে ফালতু কারণে একটা ঝগড়া হয়ে যেত এবং এর রেশ অনেক দিন পর্যন্ত চলতো। অনেক বছর রোজার ঈদের দিনে বড় ধরণের সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো। এছাড়া শীতকালের রোজার ঈদে অনেকসময় খেলাধুলার (ক্রীড়াপ্রতিযোগিতার) আয়োজন করা হতো—আমি ও শামসুল হক নির্ঘাত এসব খেলায় অতি উৎসাহের সাথে অংশ গ্রহণ করতাম। পরবর্তীকালে হাই স্কুলের খেলায় এসব ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কাজে লেগেছিলো।
রমজানের ঈদের কয়েকদিন আগে আমার বাবা কয়েকজন পল্লিগীতি গায়ককে ঈদের দিন রাত্রে এশার নামাজের পর আমাদের বাংলাঘরে এসে গান করার জন্য বলতেন। যাঁরা এসব মারফতী গান তাঁরা সবাই ছিল আমাদের গ্রামের লোক। এরমধ্যে ছিল আমাদের উত্তর পাড়ার জনাব আয়েত আলী বেপারী ওরফে ‘মফিয়ার বাপ্’ ছিলেন মরমী গায়ক এবং তিনি এই গানের আসরের নেতৃত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলো, উত্তর পাড়ার জনাব নিয়ত আলী, আমাদের উত্তর বাড়ির শামসুল হকের বাবা, বাঙ্গাল বাড়ির ইসলাম দেওয়ানের বাবা জনাব সালাম, দক্ষিণ পাড়ার জনাব কুদ্দুস ও জনাব রমিজউদ্দিন খলিফা এবং আমাদের বাড়ি থেকে থাকতেন ছফি ভাই ও বুরো ভাই। এছাড়া আরো কয়েকজন ছিলেন যাঁরা এই আসরে গানে অংশ গ্রহণ করতেন কিন্তু এই মুহর্তে তাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। অনেকসময় দুই গ্রূপে ভাগ হয়ে তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক গান করতেন এবং একদল আরেক দলকে গানে গানে প্রশ্ন করতেন এবং ওই অনুযায়ী গানের মারফত উত্তর দিতেন। অনেকেই শ্রোতা হিসেবে আসতেন এবং তাঁরা প্রায় ভোর রাতের প্রথম দিক পর্যন্ত বসে মনোগ্রাহী গান শুনতেন। আমি কোনোদিন ঐসব গানের আসরের কথা বা গায়কদের কথা ভুলিনি যদিও জীবনের ফেলে আসা দিনের অনেক স্মৃতিই আজ ভুলে গেছি। তবে এখনও বাল্যকালের গানের আসরে শোনা একটা গানের কলি আমার কানে বাজে: “কোথায় তোমার সতী নারী, আয়েত দাদাগো, তোমার কেন গো লজ্জা হইল না”।
আজকে যখন আমার বাল্য ও কৈশোরের পবিত্র রমজানের ঈদের স্মৃতিচারণ করছি তখন আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আমার ছাত্র-সুহৃদ বাবা ও আমার ফুলেশ্বরী মা-জননী আজ আর বেঁচে নেই। বহুকাল পূর্বেই তাঁরা পরোলোকগমন করেছেন। কিন্তু তাঁদের মত হৃদয়বান ও আদর্শ বাবা মায়ের সাথে প্রানভরে আমার শৈশব ও কৈশোরকালের রমজানের ঈদ উদযাপনের স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে আছে আমার হৃদয়ে। সেই স্মৃতির ক্ষয় নেই। সেই স্মৃতির মৃত্যু নেই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমার এই লেখাটি (“আমার শৈশব-কৈশোরের সোনালী-রুপালি স্মৃতিতে রমজানের ঈদ”) সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকালের ২০১৮ সালে ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকালের সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক জনাব ইলিয়াস উদ্দিন পলাশের অনুরোধে আমি লেখাটি তাঁকে পাঠিয়ে ছিলাম। তিনি নিজ উদ্যোগে আমার এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি তাঁর সাপ্তাহিকের বিশেষ ঈদ সংখ্যায় ছাপিয়ে আমাকে চির কৃতজ্ঞ করেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনাদেরকে সালাম, নমস্কারদি ও ঈদ মোবারক জানিয়ে আজকের লেখাটি শেষ করছি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রাণ-মাতানো ঈদের গান দিয়ে:
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাগিদ।।
তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্।
দে জাকাত মুর্দ্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ্।।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদ গাহে।
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত ও দুশমন হাত মিলাও হাতে।
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরীদ।।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী।
সেই গরীব ইয়াতিম মিস্কিনে দে যা কিছু মুফিদ।।”
লেখক : অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন বিভাগ, অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ক্লারক্সভিল, টেনেসি।