গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে গঠন হচ্ছে কমিটি। তদন্তে প্রমাণ মিললেও শেষ পর্যন্ত তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকছে ব্যাখ্যা চাওয়ার মধ্যেই। এ-সংক্রান্ত গোটা প্রক্রিয়া আবার বেশ সময়সাপেক্ষ। ফলে অনিয়ম প্রমাণ হলেও মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ পাচ্ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে, অনিয়ম দৃশ্যমান হওয়ায় সেগুলো প্রমাণের জন্য অনেক সময় তদন্তেরও প্রয়োজন হয় না। তদন্তেও এক ধরনের কালক্ষেপণ হচ্ছে। আর এ সুযোগে নির্বিঘ্নে মেয়াদ পূর্ণ করছেন উপাচার্যরা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আসলে উপাচার্যদের অনিয়ম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা সমাজের সার্বিক চিত্রের একটি প্রতিফলন। যদিও বিপথগামী সমাজের পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় থাকার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। আর একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার জন্য দৃষ্টান্ত হওয়ার কথা। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দৃষ্টান্ত রাখছেন ঠিকই, সেটি অনিয়মের। জবাবদিহিতা না থাকার কারণে উপাচার্যরা এসব অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। বিভিন্ন পর্ষদে জবাবদিহিতা ও গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি থাকলে এসব অনিয়ম হতো না। আর একজন উপাচার্যকে অনিয়মের শাস্তি কী দেবেন? আমার মতে, অনিয়ম করার সঙ্গে সঙ্গে একজন উপাচার্য নৈতিকভাবে পদে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেন। সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা শূন্যে নেমে আসে।
গত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষাঙ্গনের আলোচিত অনিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তার প্রশাসনকে ঘিরে। বিশেষ করে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের কন্যা ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ঘটনা খুবই সমালোচিত হয়। এ ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) করা কমিটির প্রতিবেদনেও অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ায় উপাচার্যকে দায়ী করে এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও অনিয়ম করে দেয়া নিয়োগগুলো বাতিলের সুপারিশ আনা হয়। সুপারিশটি আমলে নিয়ে রাবি উপাচার্যকে দেয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, উপাচার্যের এরূপ স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে ও শিক্ষা-গবেষণার মান নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না তার ব্যাখ্যা আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মেয়ে ও জামাতার নিয়োগের পাশাপাশি রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নিয়মবহির্ভূতভাবে দখলে রাখার অভিযোগেরও প্রমাণ পায় ইউজিসির তদন্ত দল। অভিযোগটি আমলে নিয়ে ওই বাড়ির ভাড়া বাবদ ৫ লাখ ৬১ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে উপাচার্যকে। অনিয়ম বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া ছাড়া গত কয়েক মাসে তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলেন, অনিয়ম করে কারোরই পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে একটি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় সে প্রক্রিয়ায় কিছু সময় লাগে। সময় লাগাটা স্বাভাবিক। তবে আমি মনে করি, অনিয়ম করে কারোরই পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
অনিয়মের অভিযোগে আলোচিত-সমালোচিত আরেক উপাচার্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বক্ষণিক অবস্থানের শর্তে নিয়োগ পেলেও যোগদানের পর থেকে বেশির ভাগ কর্মদিবসেই ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইউজিসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মে উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ নিয়েও ইউজিসির আরেকটি তদন্ত চলছে।
রাবি ও বেরোবি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
বেরোবিসহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির একজন সদস্য নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, আমাদের মাধ্যমে বিভিন্ন তদন্ত করানো হচ্ছে। সেখানে প্রমাণ হওয়ার পরও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এখন অনিয়ম করার পরও যখন মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ পাচ্ছে, তখন পরের উপাচার্য এসেও চিন্তা করবেন, আগেরজনের বিরুদ্ধে যেহেতু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তাহলে তিনিও ছাড় পাবেন। এভাবেই অনিয়মকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কয়েকজন উপাচার্যের অনিয়ম প্রমাণ করার জন্য তো তদন্তেরই প্রমাণ পড়ে না। নিয়োগে শর্ত থাকার পরও বেরোবি উপাচার্য যে মাসের পর মাস ক্যাম্পাসে যান না, এটা কার অজানা? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি আসলেই অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চান কিনা।
সূত্র: বণিক বার্তা