কালীগঞ্জে ‘মাদক সেবনে বাঁধা’: স্ত্রীকে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছিল স্বামী, গ্রেপ্তার ৪
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ এলাকায় সুহানা আক্তার (২৮) নামে এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছিল স্বামী। এরপর পালিয়ে গিয়ে দাড়ি-গোঁফ রেখে নিজে ভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন এলাকার মসজিদে থাকতে শুরু করে ঘাতক স্বামী আল-আমিন।
তবে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা সিনেমাকেও হার মানায়। এরপর একে একে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সম্প্রতি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নিহতের স্বামী আল-আমিন জানায়, ‘মাদক সেবনে বাঁধা দেয়ার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছিল সে।’
ঘটনায় জড়িত আল-আমীন ছাড়াও আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিষয়টি জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম।
নিহত গৃহবধূ সুহানা আক্তার ঢাকার খিলক্ষে থানার তল্লা এলাকার শহর উদ্দিনের মেয়ে।
গ্রেপ্তার আসামিরা হলো: নিহতের স্বামী কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ এলাকার সামসুদ্দিনের ছেলে আল-আমিন(৩২), একই এলাকার মৃত ওয়াব মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া (২৮), নুরুল ইসলামের ছেলে আল-আমিন(৩১) এবং নারায়ন বিশ্বাসের ছেলে রাম মন্ডল রামু(৩০)।
নিহতের স্বামী আল-আমিন বড়কাউ এলাকায় ডেকোরেটর ব্যবসা করেন। গ্রেপ্তার বাকি তিনজন তার দোকানের কর্মচারী।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিহত সুহানা আক্তারকে তার স্বামীর বাড়িতে ঘরের ভেতরে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পেয়ে উদ্ধার করে তার স্বামী আল-আমিনসহ পরিবারের সদস্যরা আশিয়ান জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পরে সুহানা বাবার বাড়ির স্বজনদের মোবাইলে মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে লাশ রেখে পালিয়ে যায় তার স্বামী আল-আমিনসহ অন্যরা। এরপর কালীগঞ্জ থানা পুলিশ ওই হাসপাতাল থেকে সুহানার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
ঘটনার পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর সুহানার বাবা শহর উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন {২৪(৯)২০}।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গৃহবধূ সুহানা আক্তারকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিলো। এরপর সুহানার পলাতক স্বামী আল-আমিনের মোবাইলের কল লিস্ট পর্যালোচনা এবং মোবাইল ট্র্যাকিং করে ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে তেরমুখ ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে রামুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য মতে টঙ্গীর আরিচপুর এলাকা থেকে নিহতের স্বামী আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আল-আমিন ঘটনার দায় স্বীকার করে এবং সহযোগী অপর দু’জনের বিষয়ে তথ্য দেন। পরে অপর দু’জনকে বড়কাউ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার চারজনকে আদালতে প্রেরণ করলে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নিহতের স্বামী আলা-আমিন ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শেখ নাজমুন নাহার-এর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
আদালতে আসামিদের দেওয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে এসআই রেজাউল করিম জানান, ”নিহত সুহানা স্বামী মাদকাসক্ত আল-আমিন নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতো। এ বিষয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ছিল। ঘটনার দিন গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে রান্না শেষে সুহানা তার স্বামীকে মাদক সেবনের করতে বারণ করে এবং আল-আমিন মাদক সেবন না ছাড়লে সুহানা আর বাঁচতে চায় না বলে তাকে জানায়। এরপর আল-আমিন তাকে বলে ঠিক আছে তাহলে তোর বেঁচে থাকার দরকার নেই।”
”পরে আল-আমিন খাবার না খেয়ে বাড়ি থেকে তার দোকানে চলে যায় এবং তার দোকানের ম্যানেজার রামুকে নিয়ে ইয়াবা সেবন করে। পরে আবার বাড়ি ফিরে আসে। সে সময় এসে দেখে তার স্ত্রী কান্নাকাটি করে খাটে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে ডেকোরেটর দোকানের কাপড়ের গাট্টি দিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রী সোহানার নাক-মুখে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য দোকানের কর্মচারী রামু, রুবেল এবং আল-আমিনসহ মোট চারজন মিলে সোহানার লাশ উড়না দিয়ে ঘরের ধরনায় সাথে ঝুলিয়ে রাখে এবং বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে তারা বাড়ির পাশে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর বিকেল পাঁচটার দিকে আল-আমিনের চাচাতো বোন আসে ভাবির সাথে দেখা করতে। সে সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবিকে ডাকাডাকি করতে থাকে সে। কোন জবাব পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা খোলে যায়। পরে ভাবির লাশ ধরনায় দেখে সে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে লাশ নামায় এবং মাথায় পানি দেয়। পরে আসিয়ান হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুহানাকে মৃত ঘোষণা করেন। সে সময় সোহানার ভাইকে ফোনে আল-আমিন জানায় তোমার বোন আত্মহত্যা জন্য ফাঁস দিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে আসলে মরে যায়। পরে আল-আমিনসহ সকলে পালিয়ে যায়। এরপর তার দোকানের ওই তিন কর্মচারীদের টাকার লোভ দেখিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে বিষয়টি গোপন রাখাতে বলে সে।”
এসআই আরো বলেন, ”অপর তিনজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালতে আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। পরে ওই দিনই তাদের তিনজনকে রিমান্ড এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারাও ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের তিনজনকে আদালতে পাঠালে তারাও ঘটনায় জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।”
তিনি আরো বলেন,”আল-আমিন দাড়ি-গোঁপ রেখে নিজে ভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন এলাকার মসজিদে থাকতে থাকে এবং সর্বশেষ টঙ্গীর আরিচপুর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে থাকতো। সে তার মোবাইল ফোন বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করতো। তার দোকানের ম্যানেজার রামুর সঙ্গে বিভিন্ন দোকান থেকে মোবাইলে যোগাযোগ করতো এবং বিকাশে টাকা নিতো।”