আলোচিতসারাদেশ

হত্যা মামলার এজাহার পাল্টানোর অভিযোগে দুদকের জালে ওসি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : একটি হত্যা মামলার আসামির সংখ্যা কমানোসহ মামলার নথি পাল্টানোর অভিযোগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে রাজশাহীর পুঠিয়ার থানার সাবেক ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে।

রবিবার (২৪ জানুয়ারি) সংস্থাটির রাজশাহী জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আল আমিন বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন (মামলা নং-১, তারিখ- ২৪/০১/২০২১)।

পুঠিয়ায় নুরুল ইসলাম নামে এক জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা প্রতিপক্ষের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটিতে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে এই অপকর্ম ঘটান ওসি। এ হত্যা মামলার এজাহারের নথিতে আসামিদের নাম, সংখ্যা অদল-বদল, ঠিকানা দেওয়ার পরও সেই ঘর খালি রাখাসহ বাদীর দেওয়া এজাহারের বর্ণনাও পাল্টে দিয়েছেন এই ওসি। তার প্রভাব বিস্তারের কথা এজাহারে লেখায় শুরুতেই বাদীকে ধমক দিয়ে তা পরিবর্তনে বাধ্যও করেন তিনি। এসব অভিযোগ এনে ওই হত্যা মামলার বাদী নিহত নুরুল ইসলামের মেয়ে নিগার সুলতানা উচ্চ আদালতে সুবিচার প্রার্থনা করেন। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে নিম্ন আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে এ অভিযোগের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। এরই ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশের এই অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক।

মামলার আসামি সাবেক ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ (৪৮), বর্তমানে পুলিশের নিরস্ত্র পরিদর্শক (বিপি নম্বর ৭১০১০০৭৯১৫) হিসেবে সিলেট ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনকষা গ্রামের মৃত ডা. মইন উদ্দিন আহমেদের ছেলে।

দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আল-আমিন ওসির বিরুদ্ধে এ মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দুদকের তদন্তে পুঠিয়ার নূরুল ইসলাম হত্যার এজাহারে আসামির নাম ও বিবরণে পরিবর্তনের প্রমাণ মিলেছে। এরপর ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত হয়। ওসি সাকিল কারসাজি করে এজাহারে আটজনের বদলে ছয়জনকে আসামি করেছেন এবং বর্ণনায় পরিবর্তন আনেন।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, নিহত নূরুল ইসলাম রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার সড়ক ও পরিবহন মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন নির্বাচনে তিনি পুনরায় সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সর্বোচ্চ ভোট পান। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফলাফল পরিবর্তন করে আব্দুর রহমান পটলকে সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেন। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করে নূরুল ইসলামসহ অপর তিনজন বাদী হয়ে রাজশাহী জেলার পুঠিয়া সহকারী জজ, ১ম আদালতে ৮ জনকে বিবাদী করে একটি নির্বাচনি মামলা দায়ের করেন (মোকাদ্দমা নম্বর ১৪/২০১৯) ।

মামলাটি শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট আদালত বিবাদীদের বিরুদ্ধে পুঠিয়া থানা সড়ক ও পরিবহন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নবনির্বাচিত কমিটির সমস্ত কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও কারণ দর্শানোর আদেশ দেন। আদালতের অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রচারিত হলে ওই মামলার বিবাদী আব্দুর রহমান পটল এবং তার সহযোগীরা নুরুল ইসলামকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। পরে একই বছরের ১০ জুন সন্ধ্যা থেকে নুরুল ইসলামের কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন ১১ জুন সকাল ১০টায় নুরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে, নুরুল ইসলামের মরদেহ পুঠিয়া এএসএস ইট ভাটার মধ্যে পড়ে আছে। নিহত নুরুল ইসলামের মেয়ে নিগার সুলতানা ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে পুঠিয়া থানায় এ ঘটনায় হত্যা মামলা করার জন্য যান এবং তার ভাষ্যমতে, তার পিতাকে হত্যায় জড়িত ৮ (আট) জন আসামি আব্দুর রহমান পটল (৫৫), আহসানুল হক মাসুদ ওরফে নেতা মাসুদ (৪৮), মিঠু ওরফে গুন্ডা মিঠু (২৮), গোলাম ফারুক (৫৫), কেএম শাহীন (৬০), নুরুল আমিন (৫৫), মো. মতিন (২৫) ও মো. আব্দুর রশিদের (৪৮) বিরুদ্ধে এজাহার দাখিল করেন।

কিন্তু এজাহারে পুঠিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শ্রমিক ইউনিয়ন নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ থাকায় তৎকালীন ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ এজাহারটি রেকর্ডভুক্ত না করে সংবাদদাতা নিগার সুলতানাকে তা সংশোধন করে এই বিষয়টি বাদ দিয়ে পুনরায় এজাহার দিতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিগার সুলতানা বিষয়টি বাদ দিয়ে পুনরায় থানায় এজাহার দাখিল করলে ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ তা গ্রহণ করেন এবং কিছু সাদা কাগজে নিগার সুলতানার স্বাক্ষর নিয়ে তাকে চলে যেতে বলেন। পরে নিগার সুলতানা পুঠিয়া থানা থেকে এজাহার ও প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপি (পুঠিয়া থানার মামলা নম্বর ৮ তারিখ: ১১/০৬/২০১৯ ) সংগ্রহ করে দেখেন যে, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামির নাম, বাসস্থান ও ঠিকানা সম্বলিত কলামে কোনও আসামির নাম না লিখে সেখানে ‘অজ্ঞাতনামা’ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং এজাহারের বর্ণনা পরিবর্তনের পাশাপাশি আসামির সংখ্যা আট জনের পরিবর্তে ছয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও আসামিদের নাম ও বয়সও বদল করায় প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা হলেন আব্দুর রহমান পটল (৫৫), একেএম শাহীন (৫৫), নুরুল আমিন (৫৫), মিঠু গুন্ডা মিঠু (২৮), আব্দুল মতিন (২৫), মো. রশিদসহ (৪৮) অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জন। অর্থাৎ সংবাদদাতা নিগার সুলতানা তার দাখিলকৃত এজাহারে সুনির্দিষ্টভাবে আট জন আসামির নাম উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুঠিয়া থানা বরাবর এজাহার দাখিল করলেও ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ কারসাজি করে ওই এজাহার পরিবর্তন করে আটজন আসামির পরিবর্তে ছয় জনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি এজাহারে বর্ণনারও পরিবর্তন করেন। তিনি আসামি কেএম শাহীনের (৬০) নাম একেএমশাহীন (৫৫) করে দেন, মো. মতিনের নাম লিখে দেন আ. মতিন। এছাড়া বেআইনিভাবে প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামির নাম ও বাসস্থান ও ঠিকানা সম্বলিত কলামে ‘অজ্ঞাতনামা’ লিখে একটি বিতর্কিত মামলা রুজু করেন।

নিগার সুলতানা ওই বিতর্কিত এজাহারের বিরোধিতা করে প্রতিকারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নম্বর ৯৮৯৫/২০১৯) দায়ের করেন। ওই রিট পিটিশনের রুল নিশি ইস্যুর সময় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নিগার সুলতানা কর্তৃক দায়েরকৃত পুঠিয়া থানা মামলা নম্বর-৮ (তারিখ: ১১/০৬/২০১৯) এর এজাহার পরিবর্তন বিষয়ে বিচারিক তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদার কর্তৃক বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান শেষে নিগার সুলতানার দায়েরকৃত এজাহার গ্রহণ না করে কারসাজিমূলকভাবে এজাহার দায়েরের ক্ষেত্রে পুঠিয়া থানার তৎকালীন ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের সন্দেহজনক ভূমিকা রয়েছে বলে সুষ্পষ্ট প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ওসি বিরুদ্ধে মামলাসহ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button