বিদ্রোহের ইতিহাসে ফকির মজনু শাহ
ভূমিকা
নৃশংস ব্রিটিশ শোষণকারীদের বিরুদ্ধে যে বীর সন্তানরা, যেমন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, কৃপানাথ, মুশা শাহ, মজনু শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলি শাহ প্রমুখ, পলাশী যুদ্ধের পর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মজনু শাহ ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারী। মজনু শাহ ১৭৬০ সাল থেকে বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দীর্ঘ ২৬ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ৫০ হাজারেরও অধিক ফকির ও সন্ন্যাসীদের সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুয়ায্যম হুসায়ন খান লিখেছেন, ‘মজনু শাহের প্রধান কৃতিত্ব হলো, তিনি ফকির ও সন্ন্যাসীদের ঐক্য অক্ষুণ্ন রেখে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তার সুদীর্ঘ সংগ্রামের অখণ্ডতা অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন।’ তিনি তার অধীনস্থ সৈন্যাধ্যক্ষদের নিয়ে সারা বাংলায় বহু সফল অভিযান পরিচালনা করেন। সেসব অভিযানে তিনি কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব অফিস ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল করেন, কোম্পানির শাসকদের তাঁবেদার জমিদারদের কাছারি লুট করেন এবং কোম্পানির সেনাবাহিনীকে পরাজিত ও নাজেহাল করেন। এসব যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য ও তাদের নিয়োজিত তাঁবেদার কর্মচারী নিহত হয়।
আলোচ্য নিবন্ধে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বিশেষ করে বিদ্রোহের পটভূমি ও বিদ্রোহে কারা জড়িত ছিলেন এবং আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা ফকির মজনু শাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তার নেতৃত্বে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনার ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহের পটভূমি
পলাশীযুদ্ধে (১৭৫৭ সালে) নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর যদিও ইংরেজ শাসককুল বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, কিন্তু ১৭৭২ সালের আগ পর্যন্ত তারা শাসনকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এর প্রধান কারণ, সম্ভবত তারা তখনো বাংলার জনগণের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তাদের আজ্ঞাবহ নবাবদের পুতুলের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। নবাবরা মাঠ পর্যায়ে শাসনের দায়িত্ব বহন করতেন, কিন্তু সামরিক ক্ষমতা বা অর্থ কোনো কিছুই তাদের এখতিয়ারে ছিল না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৭৬৩ সালে, যা অব্যাহত ছিল প্রায় চার দশক (১৮০০ সাল পর্যন্ত)। কিছু পণ্ডিতের মতে, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম দিকের যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম। সেই বিদ্রোহে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল পূর্ণিয়া, মালদা, ঢাকা, দিনাজপুর, রংপুর, কোচবিহার ও মুর্শিদাবাদ এলাকা। বলা বাহুল্য, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ মূলত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গের ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ের ফকির এবং পূর্ববঙ্গ ও ময়মনসিংহের ‘গিরি’, ‘গোঁসাই’ এবং ‘নাগা সন্ন্যাসী’রা সর্বপ্রথম সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদ উভয় সম্প্রদায়কে ‘হিন্দুস্থানের যাযাবর’ আখ্যায় ভূষিত করেন। ফকির ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায় খুব সংগঠিত না হলেও তারা নিজেদের স্বাধীনতা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইংরেজ শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলা ও বিহারের কৃষককুলের প্রেরণায় বিদ্রোহ করতে সক্ষম হয়েছিল। পরে ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, ছাঁটাই হওয়া সৈনিক এবং বিতাড়িত কৃষক আন্দোলনে যোগদান করে। এক পর্যায়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। উল্লেখ্য, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন।
তবে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। এসব মতানৈক্যের মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, পণ্ডিতদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নানা ধরনের মতবাদের প্রতি আনুগত্য। নিচে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নিয়ে বিপরীতধর্মী কিছু মতামত হাজির করা হলো (তথ্যসূত্রে উল্লেখিত অমৃত সেনগুপ্তের গবেষণাপত্রে বিস্তারিত পাওয়া যাবে):
যামিনীমোহন ঘোষ (ব্রিটিশ প্রশাসক) সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ধর্মীয় দুর্বৃত্ত হিসেবে অভিহিত করেন।
এসি চন্দ্র ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে দরিদ্র কৃষক, বেকার কারিগর এবং চাকরিচ্যুত সৈন্যদের দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। তার যুক্তি হলো, যদিও কিছু আক্রমণ কৃষক অধ্যুষিত গ্রামে হয়েছে, কিন্তু অবশ্যই জনসাধারণের এক ধরনের সমর্থন ছিল।
অতীশ কে দাশগুপ্তের যুক্তি হলো, সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে এক ধরনের জনপ্রিয় প্রতিবাদ।
সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে জনপ্রিয় কৃষক বিদ্রোহ বলে মনে করেন। তার মতে, ‘সন্ন্যাসী ও ফকিররা ডাকাত ছিলেন না।’
অন্যদিকে আনন্দ ভট্টাচার্য ধর্মীয় ভিখারি, অর্থাৎ ফকির-সন্ন্যাসীদের, প্রাথমিকভাবে বাংলার গ্রামাঞ্চলকে ধ্বংস করে দেয়া দুষ্কৃতি হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, যদিও ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে কোম্পানির বিরুদ্ধে ছিল, কিন্তু তা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না।
উইলিয়াম পিঞ্চ যুক্তি দেখিয়েছেন, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এবং মাঝে মাঝে কৃষক অংশগ্রহণে কিছু শ্রেণী মাত্রা থাকতে পারে, কিন্তু তা শুধু কৃষক যুদ্ধ ছিল—এ মতের সমর্থনে তর্ক করার জন্য যথেষ্ট উপাদান ছিল না।
ম্যাথু ক্লার্ক উল্লেখ করেছেন, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করা সন্ন্যাসীরা শুধু সন্ন্যাসী হওয়ার ভান করছিল না, বরং তারা অপরাধমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।
এছাড়া রায় বাহাদুর যামিনীমোহন ঘোষ তার ‘Sannyasi & Fakir Raiders in Bengal’ গ্রন্থে ফকির-সন্ন্যাসী সংঘর্ষকে হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা বলে অভিহিত করেছেন। হিন্দু-মুসলমানদের যৌথ কৃষক বিদ্রোহকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজদের মদদপুষ্টদের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের সংঘর্ষকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়। উদ্দেশ্য মজনুকে কিছুটা দুর্বল করা এবং বিদ্রোহী মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা।
অনেকে মনে করেন, ফকিরদের প্রতিরোধ সংগ্রাম দুনিয়ার বুকে আর দশটা জায়গায় সুফি মুজাহিদদের গড়ে তোলা অ্যান্টি-কলোনিয়াল মুক্তিসংগ্রামেরই বাংলাদেশী সংস্করণ।
কেন হয়েছিল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহ?
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহের অঙ্কুর একদিনে বেড়ে ওঠেনি। আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শত শত বছর ধরে ফকির ও সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন মন্দির ও তীর্থস্থান পরিদর্শনের জন্য উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ করতেন। ঐতিহ্য অনুসারে, তারা স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভিক্ষা সংগ্রহ করতেন। পলাশীর যুদ্ধের আগে, জমিদারদের এ ভিক্ষা দিতে কোনো সমস্যা ছিল না এবং সেই অর্থ সংগ্রহে একটি সৌহার্দপূর্ণ লেনদেন ছিল। পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভূমি কর ও কৃষকের ওপর শোষণ বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু, ১৭৭০ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ উৎপাদন কমে যায় এবং অনেক জমিদার কর পরিশোধ করতে পারেননি। স্থায়ী বসতির শর্তে অনেক পুরনো জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নতুন ক্রেতাদের দেয়া হয়। এছাড়া সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর অসংখ্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এছাড়া ব্রিটিশরা তাদের লুটেরা ও গুণ্ডা হিসেবে বিবেচনা করত। এসব কারণে এক পর্যায়ে কৃষক, বাস্তুচ্যুত জমিদার এবং এই সাধু ও ফকিররা একত্র হন। তারা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তেলি, তাঁতি, নাপিত সবাই সেদিন ফকির-সন্ন্যাসীদের পেয়েছিলেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। উল্লেখ্য, ১৭৬৩ সালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহীরা প্রথম আক্রমণ চালান ঢাকার ইংরেজ কুঠির ওপর।
সমকালীন বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র ব্যবহার করে অভিমন্যু প্রামাণিক ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের বা বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ নিবন্ধে ছয়টি কারণ বা বিষয় উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো:
১. বাংলা ও বিহারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করার জন্য সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে অনেকেই কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন। তারা ইংরেজদের শোষণের শিকারে পরিণত হয়েছিল।
২. বছরের বিশেষ সময়ে সন্ন্যাসী ও ফকির কৃষকরা তীর্থে যেতেন। ইংরেজরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের ওপর তীর্থ কর বসায় এবং তাতে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের [বাংলা ১১৭৬ সাল] সময় ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের দৃশ্য দেখে বিদ্রোহীরা ইংরেজ, মহাজন ও কিছু জমিদারের ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন।
৪. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধার্য করা অত্যধিক রাজস্ব এবং জমি থেকে ইচ্ছেমাফিক কৃষক উচ্ছেদসহ নানা কারণে বাংলা-বিহারের কৃষকরা ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন।
৫. রাজস্ব আদায়ের নামে সার্বিক লুণ্ঠন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকদের নির্দয় অত্যাচারের জন্য আন্দোলন বা বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল।
৬. ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকেই রেশম ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা নানাভাবে তাদের সেই ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা দিত।
মজনু শাহের জীবন এবং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তার অবদান
ফকির মজনু শাহ বা মজনু শাহ বোরহান ছিলেন ক্ল্যাসিক্যাল প্রি-মডার্ন ইসলামী সুফিদের প্রথম মুজাহিদ। তিনি ছিলেন বর্তমান ভারতের অন্তর্গত উত্তর প্রদেশের মাদারিয়া তরিকার একজন ফকির বা সুফি সাধু। তবে তার প্রথম জীবন সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।
‘বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হিউম্যান ট্রেন্ড অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ ব্লগ’-এ ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, ‘ফকির মজনু শাহ ছদ্মনাম।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন সুরজিৎ দাশগুপ্ত পরিবেশিত এক তথ্যের ওপর নির্ভর করে মেসবাহুল হক ব্যাখ্যা করেছেন, ‘মজনু’ শব্দটির অর্থ ‘পাগল’ এবং শাহ’ শব্দের অর্থ ‘রাজা’। তাই মজনু শাহ নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘পাগল রাজা’ বা ‘পাগলা রাজা’। আসলে এটি একটি প্রতীকী নাম। মজনু শাহ যে বহুকাল পর্যন্ত তার আসল নাম ও পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা তার ব্যক্তিগত ও ব্রিটিশবিরোধী গণশক্তির সাংগঠনিক সাফল্যের এবং ব্রিটিশ শাসকদের ও ব্রিটিশ শক্তির প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দেয়। খান চৌধুরী আমানত উল্লাহ আহাম্মদের ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ এবং নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বিশ্বকোষ’ থেকে জানা যায়, বাকের মহাম্মদ বাবাকের আলী নামে উল্লেখিত রংপুরের এক জমিদারই ছিলেন মজনু শাহ। তিনি ছদ্মনামে ব্রিটিশবিরোধী গণশক্তিকে চালনা করতেন, অথচ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতেন ব্রিটিশদের চোখের সামনে।
যাহোক, বাংলা ও বিহারের বেকার সৈন্যবাহিনী, কারিগর ও সর্বহারা কৃষকদের একত্র করে মজনু শাহ বিরাট বিদ্রোহী বাহিনী গঠন করেছিলেন। তার কর্মকাণ্ডের প্রধান ঘাঁটি ছিল দিনাজপুর ও বগুড়া জেলা। তিনি সাধারণত দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ থানার বালিয়াকান্দিতে বসবাস করতেন। বগুড়ার মাদারগঞ্জে তার একটি অস্থায়ী নিবাসও ছিল। যাহোক, উধুয়ানালার যুদ্ধ (১৭৬১) ও বক্সারের যুদ্ধের (১৭৬৪) সময় তিনি বিহারের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলার পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত অবিরাম সফর করেন এবং সেসব অঞ্চলের বৃহৎ সংখ্যক মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেন। এছাড়া তিনি আপামর জনগণকেও স্বাধীনতা, ধর্ম ও ঐক্যের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৭১ সালের শুরুর দিকে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় মজনু শাহ দলবলসহ পিছু হটে যান। তখন তার এবং অনুসারীদের ওপর গোবিন্দগঞ্জের গ্রামবাসীদের অতর্কিত আক্রমণ তাকে এতটাই ক্ষেপিয়ে তোলে যে, তিনি প্রতিশোধ নেয়ার শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, তাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তিনি আনুমানিক দুই হাজার ফকির সংগ্রহ করে বিদ্রোহী দল তৈরি করেন এবং ১৭৭২ সালের জানুয়ারিতে বগুড়া জেলার খাট্টা এলাকায় আবির্ভূত হন। সেখানে তিনি তার কার্যক্রম চালিয়ে যান এবং গরিব ও ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের কাছ থেকে অর্থকড়ি ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করেন।
ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলামের লেখা থেকে জানা যায়, ১৭৭১ সালের শরত্কালে বিদ্রোহীরা উত্তরবঙ্গে তত্পর হয়ে উঠলে মজনু শাহ নাটোরের রানী ভবানীর কাছে কৌশলী ভাষায় এক পত্র লেখেন—‘আমরা দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের সর্বত্র ভিক্ষা করে আসছি এবং বাংলাদেশের লোকেরাও আমাদের প্রতি সমর্থন ও সাহায্য জুগিয়েছে। আমরা বিভিন্ন দরগাহ বা তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেছি। আমরা কাউকে গালি দিইনি বা কারো গায়ে হাত তুলিনি। তবুও আমাদের ১৫০ জনকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করে তারা যা পেয়েছে, তা পরিধেয় বস্ত্র এমন কি খাদ্যবস্তু পর্যন্ত তারা কেড়ে নিয়েছে। এসব গরিব ফকিরকে হত্যা করে তাদের কী লাভ হয়েছে বা কী খ্যাতি তারা অর্জন করেছে, তা তাদের বলার প্রয়োজন নেই। আগে ফকিররা একাকী ভিক্ষা করে বেড়াত, এখন তারা দলবদ্ধ হয়েছে। ইংরেজদের দৃষ্টিতে এ ঐক্যবোধ অপরাধ। তারা ফকিরদের উপাসনায় বাধা সৃষ্টি করে। এটা অন্যায়। আপনিই প্রকৃত শাসক। আমরা ফকির মানুষ। আমরা আপনার মঙ্গল কামনা করি এবং আপনার সাহায্যপ্রার্থী।’
এ কথা সত্যি, মজনু শাহ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি যুদ্ধের ঘটনা তুলে উল্লেখ করা হলো:
দিনাজপুরে লেফটেন্যান্ট ফেলথামের নেতৃত্বাধীন সিপাহিদের সঙ্গে মজনু শাহর প্রথম সংঘর্ষ হয় ১৭৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সেই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে দুর্ভাগ্যবশত সেই সংঘর্ষ অসফল ছিল এবং ১৫০ জন সহযোদ্ধা নিহত হন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি বগুড়ার মহাস্থান গড়ের খানকায় চলে যান এবং পুনরায় আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
মজনু শাহ ও তার ফকিরদের দল রাজশাহীতে সন্ন্যাসীদের একটি দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৭৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিপাহিদের চারটি দলের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। সেই লড়াইয়ের সময় কোম্পানির সেনাবাহিনী পুনরায় তাদের হামলা প্রতিহত করে।
১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি ৫০০ সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের অধীনে ইংরেজ বাহিনীর সম্মুখীন হন। সেই যুদ্ধে তার বহু অনুসারী নিহত হন এবং মজনু শাহ নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হন। তার অনুচররা তাকে রাজশাহী ও মালদহ জেলা অতিক্রম করে বিহারের সীমান্তে নিয়ে যান।
কথিত আছে, ১৭৮৬ সালের পর মজনু শাহকে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। ১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি কানপুর জেলার মকানপুরে শাহ মাদারের দরগায় মৃত্যুবরণ করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। সম্ভবত যুদ্ধে আহত অবস্থায় তিনি শাহ মাদারের দরগায় ফিরে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। এভাবেই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অকুতোভয় নায়কের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।
তথ্যসূত্র:
১. A N Chandra, 1977, The post Famine incursions : The Exploits of Majnu Shah, Chapter IV, In: The Sannyasi Rebellion, Ratna Prakashan, Calcutta.
২. Amrita Sengupta, 2020, Sannyasi Fakir Rebellion, 1770-1800: A Study in Overt Form of Rebellion, NSOU-OPEN JOURNAL Vol. 3 No. 2 (July 2020).
৩. GKTODAY, Sanyasi and Fakir Rebellion, First Published: October 18, 2011; Last Updated: January 26, 2020।
৪. Jamini Mohan Ghosh, 1930, Sannyasi and Fakir raiders in Bengal, Publisher: Bengal Secretariat, 1st Edition, Paperback, January 1, 1930.
৫. মুয়ায্যম হুসায়ন খান, মজনু শাহ, বাংলাপিডিয়া, ১৭ এপ্রিল ২০১৫।
৬. মজনুশাহ, উইকিপিডিয়া।
৭. ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম, ২০১৭, বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হিউম্যানট্রেন্ড অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ ব্লগ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
৮. অভিমন্যু প্রামাণিক, ২০১২, সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, বেঙ্গল স্টুডেন্টস, ২২ এপ্রিল ২০১২।
লেখক ও অনুবাদক: ফজল হাসান