আলোচিতসারাদেশ

আড়াই বছর ঢামেক মর্গে যুক্তরাষ্ট্রের রবার্টের লাশ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রবার্ট মায়রন বার্কার (৭৮) মারা যান ২০১৮ সালের ২৫ মে। সেদিন থেকে তার মরদেহটির ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের ফ্রিজ। আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও লাশের সৎকার কিংবা স্বজনের কাছে হস্তান্তর করতে পারছে না থানা পুলিশ। রবার্টের বাংলাদেশি স্ত্রী মাজেদা বেগম স্বামীর লাশ সৎকার করার জন্য মার্কিন দূতাবাসে দৌড়ে দৌড়ে হয়রান। লাশের বিষয়ে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না তিনি।

মাজেদা বেগম বলেন, ‘কী করব, আমি কত দৌড়াইলাম, কেউ কোনো সমাধান দেয় না, কেউ আমার কথা শুনতে চায় না। একটা মানুষের লাশ এতদিন ধরে মর্গে পড়ে আছে। কেউ আমাকে সহযোগিতা করে না। আপনারা আমাকে একটু সহযোগিতা করেন। আমি আমার স্বামীর শেষকৃত্য করতে চাই।’

রবার্ট মায়রন বার্কারের মরদেহ সৎকার করা হবে না যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো হবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাচ্ছে না থানা পুলিশও। ঢামেক হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ বলছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে তার মরদেহ সৎকার করা যাচ্ছে না।

তথ্য অনুযায়ী, রবার্টের পাসপোর্টের নাম রবার্ট মায়রন বার্কার। জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জন্ম ২৪ জুলাই ১৯৩৯, ধর্ম খ্রিস্টান। পাসপোর্ট নম্বর-৪৫২০৮৬০৮৮। ঠিকানা ইন্ডিয়ানা, ইউএসএ। ভিসার বিবরণ অনুযায়ী, রবার্ট আনপেইড বা অবৈতনিক কর্মকর্তা বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। ২০১৮ সালের ২৫ মে অসুস্থ অবস্থায় দক্ষিণখানের বাসায় মারা যান রবার্ট। এরপর গত আড়াই বছর তার লাশ পড়ে আছে ঢামেকের মর্গে।

মাজেদা বলেন, ‘আমি উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে আয়া পদে চাকরি করতাম। প্রায় ১৩ বছর আগে ওই হাসপাতালে রোগী হিসেবে আসেন রবার্ট। তাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় আমি তার সেবা করতাম। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি বিধবা হওয়ায় রাজি হই। ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল খ্রিস্টান ধর্মমতে রাজধানী মেরুল বাড্ডার চার্চে আমাদের বিয়ে হয়। সেই বিয়ের কাবিননামা ও ছবিও আছে আমার কাছে।’

বিয়ের কাবিননামা অনুযায়ী, মাজেদার বাবার নাম জয়নাল আবেদীন। রবার্টের ঘরে মাজেদার কোনো সন্তান নেই। তবে আগের ঘরে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। বিয়ের পর থেকে তারা দক্ষিণখানের ৭৩৯/২, চালাবন (মাটির মসজিদ) এলাকায় অ্যাডভোকেট মুকুল মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বরার্ট কোন সংস্থায় কাজ করতেন জানাতে পারেননি মাজেদা। তিনি বলেন, ‘রবার্ট গরিব উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন। আমেরিকা থেকে টাকা আসত। তিনি ওই টাকা অসহায় দুস্থ ও গরিব মানুষকে দিতেন। আমাকে হাত খরচের জন্য মাসে তিন-চার হাজার টাকা করে দিতেন।’

মাজেদা বলেন, ‘আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর রবার্ট দুবার আমেরিকা যান। কিন্তু আমেরিকা থেকে তার কোনো আত্মীয়কে কখনো বাংলাদেশে আসতে দেখিনি। তবে মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। আমেরিকায় তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে।’ মাজেদা আরও বলেন, ‘রবার্ট কত বেতন পেতেন, কী করতেন এসব আমি কখনো জানতে চাইনি। তবে তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুর সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পরিবারের লোকজনকে জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। পুলিশকে বিষয়টি জানানোর পর তারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি নেয়। সুরতহাল প্রতিবেদন করে এবং লাশ ঢামেকের মর্গে রাখে। দূতাবাসের লোকজন রবার্টের মূল পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে। এখন সেটাও ফেরত দিচ্ছে না। এমনকি কোনো ধরনের সহযোগিতাও করছে না।’

তিনি বলেন, ‘রবার্ট চাকরির সুবাদে বাংলাদেশে এসেছেন। তার ভিসার মেয়াদও ছিল। কিন্তু তিনি হয়তো কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তার স্ত্রী-সন্তানের ওপর রাগ করেছিলেন। তিনি সর্বশেষ যেবার আমেরিকা গিয়েছেন, ওই সময় তার দুই সন্তান ও স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করেনি। আমেরিকায় এক বন্ধুর বাসায় কিছুদিন থেকে আবার বাংলাদেশে চলে আসেন। পরে আর ওই দেশে যাননি। রবার্টের ফোন থেকে ছেলেমেয়েদের মৃত্যু সংবাদ দেওয়ার জন্য অনেকবার ফোন করেছি। কিন্তু তারা কেউ ফোন ধরেনি।’

দক্ষিণখানে মাজেদার ঘরে গিয়ে রবার্টের আমেরিকান স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের ছবি ছাড়া তার পাসপোর্টের ফটোকপি, মাজেদার সঙ্গে বিয়ের ছবি, কাবিননামা, এসট্রান্স মেম্বার আইডি কার্ড, ভিক্টোরি স্কয়ার ১৬৬০ নর্থব্রডওয়ে স্প্রিংফিল্ড লেখা একটি কার্ডও পাওয়া গেছে। এছাড়া মাজেদার অ্যালবামে পথশিশুদের সঙ্গে রবার্টের কয়েকটি ছবি আছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, রবার্টের অসুস্থতাজনিত মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ মরদেহ রেখে যাওয়ার পর থেকে এখনো ফ্রিজে আছে। হাসপাতালের মর্গ সহকারী সেকান্দার জানান, প্রায় আড়াই বছরেও লাশটি কেউ নিতে এবং দেখতে আসেনি।

দক্ষিণখান থানার সাবেক ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘রবার্ট মারা যাওয়ার পর আমরা থানায় একটি জিডি করে রাখি। যার নম্বর ১৪৮৬, ২৫ মে, ২০১৮। সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে ময়নাতদন্ত করা হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় এই দেশে তার মরদেহ সৎকার করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দূতাবাসেরও ছাড়পত্র প্রয়োজন ছিল। সেগুলো পাওয়া যায়নি। রবার্টের স্ত্রী আমাদের কাছে বেশ কয়েকবার ধরনা দিয়ে পরে হাল ছেড়ে দেন। তিনি বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়াদৌড়িও করেন। আমরাও চেষ্টা করেছি কিন্তু বিষয়টির কোনো ধরনের সুরাহা বের করতে পারিনি।’

দক্ষিণখান থানার বর্তমান ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি অনেক দিন আগের। আমি থানার অফিসার ইনচার্জের দায়িত্ব নেওয়ার পর কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’

 

সূত্র: দেশ রূপান্তর

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button