গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : জমি নিবন্ধন করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি করে। পরে সেই জমি বন্ধক রেখে দুই ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ঋণ। শুধু এনআইডি নয়, ট্রেড লাইসেন্স, প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, শনাক্তকারী ও গ্যারান্টার সবই ভুয়া। এতসব জালিয়াতির পর খুব সহজেই দুটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ বের করে নিয়েছেন শিহাব উদ্দিন ওরফে আবদুল আলীম নামে এক ব্যক্তি।
জালিয়াত চক্রের এ সদস্যকে ঋণ দেয়া ব্যাংক দুটি হচ্ছে বেসরকারি প্রাইম ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এ ঘটনায় ব্যাংক দুটির করা মামলার সূত্র ধরে জালিয়াত চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গত বছরের ১২ মার্চ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা দায়ের করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। মামলার এজাহারে বলা হয়, আবদুল আলীম নিজেকে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কটন জোন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয়ে ব্যাংক থেকে সিসি লোনের আবেদন করেন। জামানত হিসেবে রাজধানীর গুলশানের কাঁঠালদিয়া মৌজার ৫০ শতাংশ জমি বন্ধক রাখা হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবদুল আলীমের ব্যবসার কাগজপত্র, তার মালিকানা দাবীকৃত জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই ও মূল্য নির্ধারণের জন্য নর্দান ইন্সপেকশন কো. লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কাগজপত্র সঠিক আছে মর্মে প্রতিবেদন দেয়ার পর ব্যাংক আবদুল আলীমকে ৬০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করে, যা ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি দুটি চেকের মাধ্যমে তিনি ব্যাংক থেকে তুলে নেন। এর কয়েকদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আবদুল আলীম ও তার ঘনিষ্ঠ লোকজন হিসেবে পরিচিত সবার মোবাইল ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। আবদুল আলীমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
পরে খোঁজ নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে পারে আবদুল আলীম সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের মূল হোতা। তার প্রকৃত নাম শিহাব উদ্দিন। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিনি আব্দুল আলীম নামে ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করেছেন। এ জাল এনআইডি কার্ড দিয়ে তিনি আবদুল আলীমের জমি রেজিস্ট্রেশন করে ব্যাংকে জামানত রেখেছেন। এনআইডি কার্ডে তার পিতা-মাতার নাম ও যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে তা-ও ভুয়া। এমনকি ব্যাংকের গ্যারান্টর হিসেবে যাদের এনআইডি জমা দেয়া হয়েছে তা-ও ভুয়া।
এদিকে বনানী থানায় দায়েরকৃত প্রাইম ব্যাংকের মামলার এজাহারে দেখা গেছে, একই ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে আবদুল আলীম নামধারী শিহাব উদ্দিন ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেখানেও ব্যবসায়ী হিসেবে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কটন জোন প্রতিষ্ঠানটি দেখানো হয়েছে। এমনকি মর্টগেজ হিসেবে প্রতারক চক্র ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে জমা দেয়া একই জমির কাগজ দেখিয়েছে। এখানে ব্যাংকের গ্যারান্টর হিসেবে আলাদা একজনের নাম ব্যবহার করা হলেও তার জমা দেয়া এনআইডিটিও ভুয়া।
এ দুটি মামলা ডিবির কাছে হস্তান্তরের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্তে নেমে প্রতারক চক্রের সদস্য আবদুল আলীম ওরফে শিহাব উদ্দিন, আবদুল লতিফ ওরফে রুবেল, আবদুস সামাদ ওরফে রাসেল, আবুল কালাম আজাদ, মো. শামীর হোসেন তালুকদার ও আবুল কাশেম ওরফে রাজুকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হলে তারা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তারা স্বীকার করেন, তারা একই ব্যক্তির ভিন্ন নামে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে, যা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে দৃশ্যমান ছিল এবং এটি দেখে ব্যাংক তাদের বিশ্বাস করে।
তবে বিশেষজ্ঞের মতে, ভুয়া এনআইডি ও জমি রেজিস্ট্রির কাগজ জামানত রেখে ঋণ প্রদানের ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না। কারণ আবেদনকারীর কাগজপত্র ব্যাংক নিজে যাচাই করার পর তা তৃতীয় পক্ষের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এরপর ব্যাংকের আইন শাখা ঘুরে তার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ার মধ্যেও এমন অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। ব্যাংক হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ঋণ প্রদান পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, এ চক্রটি একই কৌশলে একাধিক ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের এবং ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যালয়ের জালিয়াত চক্রের গোপন যোগসাজশ রয়েছে। এ কারণে তারা সহজেই এ ধরনের জালিয়াতি করার সুযোগ পাচ্ছে। তাই ওই দুই চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে তারা জোর তত্পরতা চালাচ্ছে।
আরো জানতে…
কালীগঞ্জে ‘সরকারি জমি বন্ধক’ রেখে ৬৭ লাখ টাকা ঋণ, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিক্রির চেষ্টায় ব্যাংক!
রাজ হাউজিং এর জালিয়াতি: নদী কবরস্থানের ভূমি বন্ধক রেখে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ
সূত্র: বণিক বার্তা