যেতে চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, পুলিশ পাঠিয়ে দিলো পরপারে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ (৩৪)। চাচা ময়নুল ইসলাম কুদ্দুছের স্পন্সরশিপে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় তার পরিবারের ২৩ সদস্যের একসঙ্গে দেশটিতে যাওয়ার কথা ছিল। এ সংক্রান্ত সব প্রস্তুতিও প্রায় শেষ হয়ে গেলেও চলমান করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেই প্রক্রিয়া কিছুটা পিছিয়ে যায়। আগামী নভেম্বরে মার্কিন দূতাবাসে তার কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, পুলিশের এসআই আকবর হোসেন ভুইয়া ও তার সহযোগীরা রায়হান ও তার পরিবারের এ স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে।
এমন আক্ষেপ করে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে এসআই আকবর ও তার সহযোগীরা। এমন পরিণতির কথা জীবনেও ভাবিনি।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে দিকে রায়হান বিয়ে করেন। ছোটখাটো চাকরি করলেও তাদের সংসার ছিল সুখের। তার আয়ের ওপরেই সংসার চলত। অনটনের সংসারে একটু ভালো থাকার আশার পাশাপাশি রায়হানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেকে আমেরিকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করি তার এক চাচার মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, “ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। সারাজীবন কষ্ট করে মানুষ করা ছেলেটাকে অকারণে হারাতে হয়েছে আমার। পুলিশের কাছে কান্নাকাটি করে পায়ে ধরলেও তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। এভাবে যেন আর কোনও মায়ের বুক খালি না হয় সেজন্য হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই আমি।”
সালমা বেগমের দাবি, “আমার ছেলে ছিনতাইকারী নয়। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। দশ হাজার টাকার জন্য তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। রায়হানের দুই মাসের একটি শিশু রয়েছে। আমি মা হয়ে কীভাবে এসব সহ্য করবো?”
নিহত রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ বলেন, তার বিরুদ্ধে যে থানায় মামলার কথা বলা হচ্ছে, সে তথ্যও সঠিক নয়। রায়হানের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মাদক মামলাটিও পরিকল্পিত ছিলো।
স্বজনরা জানান, রায়হানের বাবা রফিকুল্লাহ ছিলেন বিজিবি’র হাবিলদার। কয়েক বছর আগে মারা তিনি যান। তারা দুই ভাই দুই, বোনের মধ্যে রায়হান ছিলেন সবার বড়।
জানা গেছে, রায়হানের বাবা রফিকুল্লাহ ছিলেন বিজিবির সৈনিক। রায়হান যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন তখন তার বাবা মারা যান। এরপর থেকে শুরু হয় রায়হানদের পরিবারের সংগ্রাম।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই মাস বয়সী মেয়ে আলফাকে কোলে নিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
তান্নি বলেন, “অভাব-অনটন থাকলেও আমাদের সংসার ছিল সুখের। সেই সুখ নষ্ট করে দিয়েছে পুলিশ। আমাদের মেয়ের কাছ থেকেও তার বাবাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারা পুলিশের পোশাক পরে অমানুষের কাজ করেছে।”
প্রসঙ্গত, নিহত রায়হানের আখালিয়া নেহারীপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। সিলেট নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতেন তিনি। ঘটনার দিনও (শনিবার) যথারীতি কাজে যান। রাতে বাড়িতে না ফেরায় স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
নিহতের চাচা মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, “রাত চারটার দিকে রায়হান একজন পুলিশ সদস্যের মুঠোফোন দিয়ে তার মাকে কল করে বলেন, ‘আমারে বাঁচাও, ১০ হাজার টাকা লইয়া তাড়াতাড়ি ফাঁড়িতে আও।’ এরপর পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হন রায়হানকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে নগরীর কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে পাশে ফাঁড়িতে রায়হানের সন্ধানে গেলে ডিউটিরত কনস্টেবল বলেন- ‘সবাই ঘুমে। সকালে আসেন।”
যেতে চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, পুলিশ পাঠিয়ে দিলো পরপারেতিনি আরও অভিযোগ করেন, রায়হানের পায়ের তলা ও হাঁটুর নিচসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। ফাঁড়ির ভেতর পুলিশের নির্যাতনেই তার মৃত্যু হয়েছে।
রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় রবিবার (১২ অক্টোবর) দিবাগত রাত আড়াইটায় সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করন তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
এর আগে ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর ঘটনাটি তদন্তের আশ্বাস দেন বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন