আলোচিত

মেট্রো হবে জেনেও এ অপচয় কেন?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নব্বই কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ভিআইপি সড়কে মাটির নিচে বিদ্যুতের লাইন বসায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ২০১৮ সালে লাইনটি বসানো হয় ভিআইপি সড়কের ঠিক বিভাজক বরাবর। সড়কটিতে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ায় বছর না পেরোতেই লাইনটি তুলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঘেঁষা ফুটপাতে বসাতে হয়েছে।

একই সড়কের ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার অংশে মাস তিনেক আগেই প্রায় ১০৪ এলইডি সড়কবাতি লাগিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মেট্রোরেলের গতিপথ বরাবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বসিয়েছে আরো অন্তত ৫০০টি এলইডি সড়কবাতি। মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞ শুরু হওয়ায় এখন খুলে ফেলতে হচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনের লাগানো এসব সড়কবাতি, যাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি টাকার বেশি।

শুধু তা-ই নয়, গত দুই-তিন বছরে ড্রেনেজ-ফুটপাত, ফুটওভারব্রিজ, ট্রাফিক সিগন্যাল, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ বাবদ অন্তত দেড়শ কোটি টাকার বিনিয়োগ অপচয় হচ্ছে। যদিও নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ভালোভাবেই জানত, এ পথ দিয়ে মেট্রোরেল যাবে। কারণ মেট্রোরেল প্রকল্প নেয়া হয়েছে এর আগেই। নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের গতিপথে গত দেড়-দুই বছরে অপচয় হওয়া এ বিনিয়োগের জন্য তাই রাজধানীর উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উত্তরা-আগারগাঁও হয়ে গত মাসে ঢাকার ভিআইপি রোডে উঠেছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। সড়কটির ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে তিন মাস আগে লাগানো হয়েছে প্রায় ৬০০ এলইডি সড়কবাতি। মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞে এরই মধ্যে এগুলোর অর্ধেক সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাকিগুলোও শিগগিরই সরানো হবে।

ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার অংশের বিভাজকে ৫২টি খুঁটিতে বসানো হয়েছে ১০৪টি এলইডি সড়কবাতি। এগুলো কেনা হয়েছে জার্মানি থেকে। প্রতিটির দাম ৪৭ হাজার টাকা। মেট্রোরেলের কারণে সদ্যস্থাপিত এসব বাতি সরিয়ে ফেলা হবে। এরই মধ্যে কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ পর্যন্ত অংশে অপসারণ করা হয়েছে এ রকম আরো অন্তত ১২০টি এলইডি সড়কবাতি। অন্যদিকে শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত এলইডি সড়কবাতি আছে ৩৮টি। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত এলইডি বাতি আছে আরো ৫৬টি। সেখান থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এলইডি সড়কবাতি আছে আরো অন্তত ৩০০টি। এর মধ্যে বাংলামোটর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এলইডি লাইটগুলো লাগিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি এলইডি সড়কবাতির দাম পড়েছে ৫৪ হাজার টাকা। এর বাইরে প্রতিটি পিলারের খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা।

রাজধানীর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক উন্নয়ন, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণে ২০১৬ সালের পর থেকে ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে দুই সিটি করপোরেশন। এসব অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভিআইপি রোডের ফুটপাত-ড্রেন উন্নয়নে। কিন্তু মেট্রোরেলের কারণে ভাঙতে হচ্ছে কমবেশি আট কিলোমিটার ফুটপাত-ড্রেন।

খামারবাড়ি মোড় দিয়ে ফার্মগেটে এসে ভিআইপি রোডে উঠবে মেট্রোরেল। এজন্য ফার্মগেট পার্কসংলগ্ন ফুটপাত তুলে ফেলা হয়েছে। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার অংশটিতে এখনো কাজ শুরু হয়নি। তবে কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ পর্যন্ত অংশে কাজ চলছে পুরোদমে। মেট্রোরেলের কারণে বাংলামোটরের পর থেকেই ফুটপাত ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ফুটপাতের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে থেকে শাহবাগ পর্যন্ত। এ অংশে মেট্রোরেলের লাইনটি যাবে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে। এ কারণে সেখান থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পুরো ফুটপাতটি তুলে দিয়ে চলছে পাইলিংয়ের কাজ।

শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘর-চারুকলাঘেঁষা ফুটপাতটিও তুলে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পরিষেবা স্থানান্তরের কাজে শাহবাগ থেকে আজিজ সুপার মার্কেট পর্যন্ত জাদুঘরের ধারঘেঁষা ফুটপাতও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালের পর পরীবাগে নির্মাণ করা হয় একটি ফুটওভারব্রিজ। এতে ব্যয় হয় প্রায় এক কোটি টাকা। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় মাস ছয়েক আগে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনের ফুটওভারব্রিজটি নতুন করে নির্মাণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এটি নির্মাণেও কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। মেট্রোরেলের কারণে ভাঙতে হবে দুটি ফুটওভারব্রিজই। পাশাপাশি ফার্মগেট, বাংলামোটরের ফুটওভারব্রিজগুলোও ভেঙে ফেলতে হবে। কাজ শুরু হওয়ায় এরই মধ্যে শাহবাগ ও প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটওভারব্রিজ দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাংলামোটরে কেইস প্রকল্পে নির্মিত একটি যাত্রী ছাউনিও মেট্রোরেলের কারণে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সিগন্যাল বাতিতে বিনিয়োগ করা বিপুল পরিমাণ অর্থও গচ্চা যাচ্ছে।

ঢাকার উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই ভিআইপি রোডে বিনিয়োগ করা বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, ডিটিসিএ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়— সবার অবহেলাতেই বিদ্যুতের পোল ভাঙতে হচ্ছে, ফুটপাত ভাঙতে হচ্ছে, ওভারব্রিজ ভাঙতে হচ্ছে। অথচ এসব সংস্থা একটু সতর্ক থাকলেই বিষয়গুলো এড়ানো যেত।

ঢাকার উন্নয়নে কাজ করছে সরকারের আট মন্ত্রণালয়ের ২৬টি বিভাগ ও সংস্থা। এসব সংস্থার কাজের সমন্বয় করার দায়িত্ব ডিটিসিএর। ডিটিসিএ এই দায়িত্বটি প্রত্যাশা অনুযায়ী পালন করতে পারছে না বলে স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমাদের জনবল সংকট। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় আমরা সেভাবে সংগঠিত ছিলাম না। এজন্য প্রত্যাশামাফিক আমরা কাজ হয়তো করতে পারছি না। তবে আমরা ভবিষ্যতের দিকে নজর দিচ্ছি।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button