কালীগঞ্জে পুলিশের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ফিরল লাশ হয়ে?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পুলিশের ধাওয়ায় খেয়ে পানিতে ডুবে নিখোঁজের তিনদিন পর লাশ হয়ে ফিরল মুক্তিযোদ্ধার ছেলে রিয়াদ সিকদার(৩০)।
বুধবার সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে কালীগঞ্জ পৌরসভার মূলগাঁও এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রক্তাক্ত মরদেহ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা দেখতে পায়। পরে সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত রোববার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পুলিশ ধাওয়ায় দিলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে ডুবে রিয়াদ নিখোঁজ হয়েছিল।
নিহত রিয়াদ সিকদার কালীগঞ্জ পৌর এলাকার মূলগাঁও গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত শাহজাহান সিকদারের ছেলে।
এর আগে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছিল, ঘটনার পর নিখোঁজের বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে পুলিশ।
নিহতের ভাই রিফাত শিকদার জানান, নিখোঁজের তিনদিন পর রিয়াদের রক্তাক্ত মরদেহ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা আমাদের খবর দেয়। পরে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। রিয়াদের রক্তাক্ত মরদেহে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মনে হচ্ছে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নদীতে পরে ছিল। তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমারা ধারণা করছি। টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ডুবরিদল সোমবার এবং স্থানীয় লোকজন মঙ্গলবার সারাদিন চেষ্টা চালিয়েও রিয়াদের কোন সন্ধান করতে পারেনি। কিন্তু আজ ঘটনাস্থলের কিছু দূরত্বেই তার মরদেহ পাওয়া যায়?
কালীগঞ্জ থানার কর্তব্যরত অফিসার সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) মুনছের আলী জানান, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা (নং ০৩/১৯) দায়ের হয়েছে এবং মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার বলেন, ধারণা করা হচ্ছে পুলিশের অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে ওই যুবক নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাশ জানান, নিহতের মরদেহে পচন ধরেছিল এবং কিছু অংশ রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। ময়না তদন্ত রিপোর্টের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিয়াদ এবং তার তিন স্বজন দুলাল, রূপম, ও আইয়ুুব শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মাটির ব্যবসা করতো। মাটি বিক্রি করছে এমন খবর পেয়ে গত রোববার ভোরে কালীগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিমের নেতৃত্বে মূলগাঁও এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অভিযান চালায় পুলিশ। একপর্যায়ে ধাওয়া করলে সকলেই পালিয়ে যায়। তবে রিয়াদ সিকদার ওই মুহুর্তে পালাতে পারেনি। পরে সে পুলিশের ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়।
ঘটনার পর রোববার দিনভর অভিযান চালিয়ে মাটি বিক্রির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলো পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজৈর এলাকার নূর নবী (৪০), আকাশ(২০), সৈয়দ আহমদ(২২), ইমরান হোসেন (২৩) ও মো. রনি(২৫)।
নিহতের ভাই রিফাত শিকদার মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, মূলগাঁও গ্রামে তাদের জমির পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর থেকে তার ভাই গত সপ্তাহখানেক আগে থেকে মাটি বিক্রি করছিল। ক্রেতারা নৌকাযোগে মাটি নিয়ে যেত। রোববার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তার ভাই রিয়াদ এবং তাদের তিন স্বজন দুলাল, রূপম, ও আইয়ুুব নদীর নৌকায় মাটি উঠানো এবং মাটি কাটা দেখতে যান। এসময় কালীগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম ফোর্স নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। এসময় সকলেই পালিয়ে যায়। তবে তার ভাই রিয়াদ সিকদার ওই মুহুর্তে পালাতে পারেনি। সে পুলিশের ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে বলে স্থানীয় তাদের জানিয়েছে।
রিফাত সিকদার আরও জানান, পানিতে ডুবে নিখোঁজ হওয়ায় পর তারা টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল কে খবর পাঠান। ডুবুরি দল থানার সাধারণ ডায়েরী ছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান করতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা কালীগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে উপ পরিদর্শক রেজাউল করিম পুলিশের ধাওয়ার বিষয়টি জিডি থেকে বাদ দিতে বলে। পরে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পুলিশের ধাওয়ার বিষয়টি বাদ দিয়ে রোববার রাত আটটার দিকে সাধারণ ডায়েরী (নম্বর ৬৫৭) করা হয়। সাধারণ ডায়েরীটি করেন নিখোঁজ রিয়াদের শ্বাশুড়ী পারভীন আক্তার। এসময় রিয়াদের মা রীনিা বেগমও সাথে ছিলেন।
পরে টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ডুবরিদল সোমবার এবং স্থানীয় লোকজন মঙ্গলবার সারাদিন নদীতে তল্লাশি চালিয়েও রিয়াদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি।
জিডিতে উল্লেখ রয়েছে, প্রাণআরএফএল কোম্পানির পিছনে শীতলক্ষ্যা নদীর তির থেকে অবৈধভাবে মাটি বিক্রি করত নিখোঁজ রিয়াদ, একই এলাকার শুক্কুর আলীর ছেলে মো. দুলাল (২৫), মৃত আব্দুল রশিদের ছেলে মো. আইয়ুব (৩৫) ও রুপম (২৫)। তারা অবৈধভাবে মাটি কাটার সময় ভোর ৬টায় সেখানে অভিযান চালায় কালীগঞ্জ থানার সহকারি পরিদর্শক (এসআই) মো. রেজাউল করিম। ঘটনাস্থল থেকে ৫ জনকে আটকের খবর পেয়ে থানায় গিয়ে নিখোঁজ রিয়াদের সন্ধান পায়নি জিডির অভিযোগকারী। পরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন রিয়াদ পুলিশি অভিযানের সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। এরপর থেকে নদীতে তল্লাশী করে তিন দিনেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৮টা ৫মিনিটে ওই জিডি গ্রহণ করেন কালীগঞ্জ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এরশাদ উকিল।
এর ঠিক কিছু সময় পরই রাত সাড়ে আটটার দিকে অবৈধভাবে নদীর মাটি উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগে এসআই রেজাউল করিম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন [নম্বর ২১(২)১৯]। ওই মামলায় মোট ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। নিখোঁজ রিয়াদ সিকদারকেও ওই মামলায় সর্বশেষ আসামী হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মামলার তদন্তকরী কর্মকর্তা এসআই মাহমুদুল ইসলাম।
মামলায় অভিযুক্ত ১২ জনকে সরকারি জমি থেকে মাটি চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। জব্দ তালিকায় রয়েছে মাটি ভর্তি ট্রলার, ৬টি মাটির টুকরি, ৫টি কোদাল ও আনুমানিক ১৫০ ঘনফুট মাটি। ট্রলারে থাকা মাটির মূল্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
যদিও মামলার এজাহারে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার সময় উল্লেখ করেছে ভোর সাড়ে ছয়টায়। কিন্তু মামলা রেকর্ডের সময় দেওয়া হয়েছে রাত ৮.৩০ মিনিটে অর্থাৎ প্রায় পনের ঘন্টা পরে?
আর নিখোঁজের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরী করা হয় রাত ৮.০৫ মিনেটে।
মামলার জব্দ তালিকায় সাক্ষী করা হয়েছে তিনজনকে।
এজাহারে উল্লেখিত ঘটনা এবং মামলার ব্যাপাারে দুই সাক্ষী কালীগঞ্জের দড়িসোম এলাকার মৃত বিল্লাল হোসেনের ছেলে তাহের হোসেন ও মৃত ছুরত আলীর ছেলে আব্দুল লতিফ বলেন, পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে কিনা তা দেখিনি। তবে ট্রলার পাহাড়া দেয়ার জন্য আমাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে।
অপর সাক্ষী থানার এএসআই রফিকুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর মিয়া তার ব্যবহৃত সরকারি মুঠোফোনে মঙ্গলবার বলেছিলেন , রিয়াদ পুলিশের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে নিহতের খবর আমাদের জানা নেই। তবে তার লোকজন বলতেছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, সে চুরি করে মাটি বিক্রি করত। সে মাটি কাটার ঘটনাস্থলে ছিল। আমরা তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল নিয়ে এসে রোববার ও সোমবার কাজ করেছি। কিন্তু এ পর্যন্ত তার বডি পাওয়া যায়নি। আমাদের পুলিশ কাউকে ধাওয়া করেনি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। যারা পালিয়ে গেছে তাদের নামেও মামলা হয়েছে। পালিয়ে যাওয়াদের তালিকায় রিয়াদের নামও রয়েছে।
নিখোঁজের জিডি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, জিডির পরই নিখোঁজের বিষয়টি তিনি জেনেছিল।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিমের মোবাইল ফোনে একাধীকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ডুবরি জহির উদ্দিন মঙ্গলবার বলেছিলেন, সোমবার সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা নদীতে তল্লাশি করে নিখোঁজ যুবকের কোন সন্ধান পাইনি।
পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজৈর এলাকার ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন জানান, পাঁচ জনকে গ্রেপ্তারের বিয়ষটি এলাকাবাসীর কাছে শুনেছি। তবে তিনি গ্রেপ্তারের সময় বলতে পারেনি।
উল্লেখ্য, গত ১৫ জানুয়ারি উপজেলার মুক্তারপুরের শাওরাইদ বাজার থেকে নদীর জমি থেকে মাটি কাটার অভিযোগে কয়েকজনকে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চলমান অবৈধভাবে মাটি কাটা বন্ধ করছে না পুলিশ।
এ সংক্রান্ত আরো জানতে….
কালীগঞ্জে পুলিশের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে যুবক নিখোঁজ: ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা পুলিশের?
শীতলক্ষ্যার তীর কেটে ইটভাটায় মাটি বিক্রি: নীরব স্থানীয় প্রশাসন