আলোচিত

করোনায় ম্লান ঈদের আনন্দ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : করোনা মহামারিকালে আরেকটি ঈদ পালন করছেন বাংলাদেশের মানুষ। স্বাস্থ্য সংকট আর অর্থনৈতিক দুরবস্থায় এবার কোরবানির চিত্রটা ভিন্ন ছিল। তারপরও মানুষ উদযাপন করেছেন সাধ্যমত।

‘‘হে আল্লাহ, যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সুস্থতা দান করুন। আপনি এই ভাইরাস থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করুন, আমাদের মাফ করুন। সারা পৃথিবীর মানুষকে মাফ করে দিন। সারাবিশ্বকে করোনামুক্ত করে দিন। আমিন।’’ শনিবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদের প্রথম জামাত শেষে এভাবেই মোনাজাতে আকুতি করেন জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মো. মিজানুর রহমান।

করোনা আর বন্যার মধ্যে ঈদুল আজহায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা কেমন ছিল? জানতে চাইলে হাফেজ মুফতি মাওলানা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা আগে থেকেই মসজিদে আসা সকলকে সতর্ক করেছিলাম, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং সরকারি বিধি বিধান মেনে জামাতে অংশ নিতে। তারা সেটা মেনেই ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন। আসলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, কিন্তু সেটা আগের মতো নয়৷ পরিস্থিতিটা তো আসলে স্বাভাবিক নয়। তবে সবাই ধর্মীয় বিধি বিধান মেনেই ঈদুল আজহা পালন করছেন। আমরা যেন সামনের সময়ে উৎসবগুলো সবাই মিলে উদযাপন করতে পারি আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই করেছি।’’

করোনার কারণে এবারও জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি৷ মসজিদগুলোতেই সবাই নামাজ আদায় করেছেন। জাতীয় মসজিদে ঢোকার আগে আগতদের মাস্ক আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিয়েছেন প্রবেশমুখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। নামাজের জন্য মুসল্লিদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে বসতে দেখা যায়। প্রত্যেকেই নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসেন। তবে শিশু ও বৃদ্ধসহ অসুস্থ ব্যক্তি বা অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা জামাতে অংশ নেননি।

রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বঙ্গভবনে ঈদের নামাজ আদায় করেন৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে সবাইকে বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘এবার আমরা এক সংকটময় সময়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করছি। করোনা ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। আমাদের সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা জনগণকে সকল সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।’’

শেষ মুহুর্তে কোরবানির পশুর সংকট

করোনার কারণে মানুষের সামর্থ্য কমে গেছে৷ ফলে এবার খুব একটা কোরবানি হবে না, এমনটাই ধরণা করেছিলেন সবাই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এই ধারণা পাল্টে যায়। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই রাজধানীর পশুহাটগুলোতে কোরবানির পশুর সংকট দেখা দেয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত কোরবানির পশু কিনতে পারেননি। এমনকি যারা গরু কিনতে চেয়েছিলেন, তারা না পেয়ে খাসি (ছাগল) কিনতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে কিনতেই পারেননি।

মেহেরপুর থেকে ঢাকার বাড্ডার নতুন বাজারে ৪০টি গরু এনেছিলেন মো. হুমায়ুন মিয়া। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একটি গরুও তিনি বিক্রি করতে পারেননি। শুক্রবার সকালে এক ঘণ্টার মধ্যে তার সবগুলো গরু বিক্রি হয়ে যায়। ৮০ হাজার থেকে চার লাখ টাকা দামে গরুগুলো তিনি বিক্রি করেছেন। হুমায়ুন মিয়ার মতে, শেষ মুহুর্তে অনেকেই গরু পাননি। পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও বহু মানুষকে গরু না কিনেই ফিরে যেতে হয়েছে। নিজের গরুগুলো তিনি পছন্দসই দামেই বিক্রি করতে পেরেছেন বলে জানান।

কর্মস্থলেই ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধারা

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আগেই ছুটি বাতিল করা হয়। ফলে তারা কর্মস্থলে থেকেছেন। কোভিড পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকাংশই হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।

জাতীয় অর্থপেডিক ও পুর্নবাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘করোনার কারণে শুধু নয়, অধিকাংশ ঈদেই আমাদের কর্মস্থলে থাকতে হয়। তারপরও কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ছুটি পেতেন। কিন্তু এবার করোনার কারণে কেউ ছুটিতে যেতে পারেননি। আমি নিজেও ঈদের দিন হাসপাতালে ডিউটি করছি। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে শুধু ডিউটি নয়, পরিবার থেকেও আমরা অনেকদিনই বিচ্ছিন্ন রয়েছি।’’

অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে ঈদ

করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঈদে কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। ফলে গার্মেন্টস কর্মীরা ঈদ করতে বাড়ি যাননি। অর্থনীতি সচল রাখতে দু’এক দিনের মধ্যে গার্মেন্টসগুলো খুলে দেয়া হবে।

করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেকে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। আবার আর্থিক দুরবস্থার কারণে শহর ছেড়েছেন বহু মানুষ। অর্থনীতিবদদের হিসাবে কয়েক কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র্য হয়ে পড়েছেন। এমন বাস্তবতায় ঈদ পালন নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক দুরবস্থা তো শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই এর ঢেউ লেগেছে। এখন সরকার কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। ইতোমধ্যে মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে। দুই কোটিরও বেশি মানুষ তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। আগে যারা গরু কোরবানি দিতেন এবার তারা হয়তো খাসি কোরবানি দিচ্ছেন। যিনি লাখ টাকার গরু কিনতেন এবার তিনি হয়তো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনছেন। সব মিলিয়ে এর সামাজিক প্রভাবটা বেশ খারাপ। এতে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে৷ যেটা আমরা চাইব না।’’

বর্জ্য অপসারণে ব্যাপক তৎপরতা

কোরবানির বর্জ্য অপসারণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নেমেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণের জন্য সাড়ে ৭০০ যানবাহন ব্যবহার করছে তারা। সেই সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বর্জ্য অপসারণে সাড়ে ১৭ হাজার কর্মী মাঠে থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘দ্রুত কোরবানির বর্জ্য অপসারণের জন্য নগরীতে ২৫৬টি স্থান চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। এবার প্রায় ১০ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হবে। প্রতিবছরের মতো এবারও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ করা হবে।’’

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তিন শতাধিক যানবাহন বর্জ্য অপসারণে কাজ করছে। এছাড়া ১২টি পানির গাড়ির মাধ্যমে স্যাভলন ও ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে পানি ছেটানো হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণমুক্ত রাখতে তারা ৪২টন ব্লিচিং পাউডার ও এক হাজার ৮০০ লিটার তরল জীবাণুনাশক ছেটাবে। তাদের নিজস্ব, আউটসোর্সিং এবং প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার কর্মীসহ ১১ হাজার ৫০৮ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী মাঠে রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনেও সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হবে। বর্জ্য সংরণের জন্য তারা প্রায় ১ লাখ বিশেষ ধরনের ব্যাগ বিতরণ করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও বলেছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা সব বর্জ্য অপসারণ করবেন।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button