অর্থনীতিআলোচিতসারাদেশ

সর্বশেষ ২৫টি পাটকল বন্ধের মাধ্যমে দেশে সরকারি পাটকল যুগের অবসান

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সর্বশেষ ২৫টি পাটকল বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকারি পাটকল যুগের অবসান হলো। পাটমন্ত্রী বলেছেন, ভবিষ্যতে এই পাটকলগুলো পাবলিক- প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চালুর সম্ভাবনা আছে৷ তখন দক্ষ শ্রমিকরা কাজ পাবেন।

২৫টি পাটকল বন্ধের ফলে ২৫ হাজারেরও বেশি স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারালেন। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, স্থায়ী শ্রমিকদের আগামী দুই মাসের মধ্যে শ্রম আইন অনুযায়ী সব পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দেয়া হবে। এজন্য সরকারের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। তবে অস্থায়ী এবং বদলি শ্রমিকরা এই বন্ধের ফলে বাড়তি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না।

সরকার অব্যাহত লোকসান দেখিয়েই রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করলো। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ জুটমিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪৮ বছরে মাত্র চার বার পাটকলগুলো লাভ করতে পেরেছে। ৪৪ বছরই লোকসান দিয়েছে। বর্তমানে এর পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যদিও বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করছে।

পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘শ্রমিকদের দুই ধাপে পাওনা পরিশোধ করা হবে। আর পিপিপি’র আওতায় আধুনিকায়ন করে পাটকলগুলো আবার চালু হবে৷ তখন এই শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পাবেন।

শ্রমিক পল্লীতে কান্না

১ জুলাই থেকে বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও পাটকলগুলো ২ জুলাই রাতে বন্ধ করা হয়। খুলনা প্লাটিনাম জুটমিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন জানান, বন্ধের সময় শ্রমিকরা বিভিন্ন পাটকলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এখনো খুলনার শ্রমিক পল্লীতে কান্নার রোল চলছে।

শ্রমিকরা পাটকলের শ্রমিক কলোনিতে থাকেন৷ অনেকেরই পরিবার ও সন্তান আছে। সন্তানরা লেখাপড়া করছে। তাই তারা এখন দিশেহারা। তবে যারা ব্যাচেলর, তারা খুলনা ছাড়তে শুরু করেছেন।

পাটকলগুলোতে লোকসান অব্যাহত থাকলেও শ্রমিক নেতারা মনে করেন, এর দায় শ্রমিকদের না। ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনার কারণেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ সময়মতো আধুনিকায়ন করা হয়নি। পাটের বিকল্প পণ্যের দিকে না গিয়ে শুধু বস্তা তৈরির কারণেই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ আর পাট সংগ্রহেও ভ্রান্ত নীতি এর কারণ।

আলিম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম লিটু বলেন, ‘‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। সরকারের সাথে তো যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে পাটকলগুলোকে বাঁচানো সম্ভব ছিল। বেসরকারি পাটকল ব্যবসা করতে পারলে আমরা কেন পারবো না! তবে সেটা তো আর আমাদের ওপর নির্ভর করে না। আধুনিকায়নের দরকার ছিল, তা করা হয়নি।”

পাটকল বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি নেই৷ শ্রমিক নেতাদের একদিন আগেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডেকে কোনো আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আন্দোলন করতে পারেন এরকম শ্রমিক নেতাদের আগেই ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।

তবে পাটকল বন্ধে একটি গ্রুপ যে আনন্দ মিছিলের আয়োজন করেছে তাতে প্রশাসন বাধা দিচ্ছে না। পাটকল শ্রমিক লীগের উদ্যোগে এই আনন্দ মিছিল হচ্ছে।

বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো ঢাকা , খুলনা ও চট্টগ্রামে৷ এরমধ্যে ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে ১০টি এবং খুলনায় আটটি। তবে খুলানার পাটকলগুলোই বড় আকারের।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ১৯৯৩ সালে পাটকল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে বিএনপি সরকার যে চুক্তি করে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধ হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ব করেছিলেন আর তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে সব বন্ধ হলো।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিকল্পনা দিয়েছিলাম যে, এক হাজার কোটি টাকা খরচ করলে কীভাবে পাটকল আধুনিক এবং লাভজনক করা যায়। কিন্তু সরকার আমাদের সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। আমলাদের কথায় কাজ করেছে।”

‘‘এই করোনার মধ্যে ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হলো। তারা তাদের পাওনা পাবেন। কিন্তু আরো ১১ হাজার বদলি এবং অস্থায়ী শ্রমিক আছেন। তারা বেতনের বাইরে কোনো সুবিধা পাবেন না। এখন সব শিল্প কারখানা সরকারের দেখানো পথে হাঁটবে৷ অনেক শ্রমিক কাজ হারাবে। এই অমানবিক কাজ এখন না করলেও চলতো। আমার মনে হয়েছে এটা শ্রমিকদের বড় অপমান,” বললেন এই শ্রমিক নেতা।

যুগের অবসান

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সরকার দেশের বিভিন্ন খাতের সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে। মিলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন কর্পোরেশন বা সংস্থাকে৷ বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)-কে পাটকলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন মোট ৮৭টি পাটকলকে রাষ্ট্রায়ত্ব করা হয়৷ কিন্তু পাটকলগুলো ধীরে ধীরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ক্রমাগত লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর পর ২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। তারপর কয়েক ধাপে আরো পাটকল বন্ধ করা হয়। আর এবার সেই ধারায় ২৫টি পাটকল বন্ধ করা হলো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল যুগের অবসান হলো।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button