লাইফস্টাইল

ভালোবাসার সেকাল-একাল

গাজীপুর কণ্ঠ ,লাইফস্টাইল ডেস্ক : সাত দোযখে যেতে রাজি/ তুমি যদি ধর বাজি/ তোমায় ছাড়া চাইনা আমি/ আট বেহেস্তের সুখ/ চাইনা হারাতে তোমায়/ শূন্য করে বুক। প্রেমিক যুগলের এমন সুর প্রেমকে টেনে নেয় মনের গহিনে। তাই তো প্রেম অমর। এ প্রেমের জন্যই বারো বছর পুকুরে বঁড়শি বেয়েছিলেন চণ্ডিদাস। ভালোবাসার জন্য লাইলি-মজনু অমর হয়ে আছেন জগতে। শিরি আর ফরহাদের কাহিনী সবার মুখে মুখে। আবার সম্‌্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর জন্য তাজমহল করে প্রেমের জ্বলন্ত সাক্ষী রেখে গেছেন। বাংলার শেষ নবার সিরাজ উদ দৌলা তার খাস বাঁদিকে ভালোবেসে বেগম বানিয়েছেন।

এককথায় পৃথিবী সৃষ্টিই হয়েছে প্রেমের ওপর ভর করে। যুগ পাল্টেছে। প্রেমের ধরনও পাল্টেছে। সে যুগের প্রেম আর এ যুগের প্রেমে এসেছে বিরাট ফারাক। যতই ফারাক থাকুক প্রেমে কি ফারাক আছে? না! প্রেম প্রেমই। এই প্রেম কে ঘিরেই শুরু ভালোবাসা দিবসের। যে ভালোবাসায় নেই কোনো খাদ, নেই কোনো প্রতারণা। প্রেমই পারে একমাত্র রক্তের বন্ধন ছিন্ন করতে। প্রেম বা ভালোবাসা কোনো একদিবসকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। তার পরও জীবনে প্রেম-ভালোবাসার আধিক্য প্রমাণেই ভালোবাসা দিবসের প্রচলন। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।

এ দিবসটিকে ঘিরে প্রেমিক যুগল সাজিয়েছে তাদের পরিকল্পনা। এ দিবসকে ঘিরেই প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা তার মনের মানুষটিকে শুনাবে তাদের স্বপ্নের কথা। প্রেমের পূর্ণাঙ্গ পরিণতি বিয়ে নিয়ে আলোচনা করবে। গোটা বিশ্বই এই ভালোবাসা দিবসে বিলিয়ে দেবে ভালোবাসা। শুধু প্রেমিক প্রেমিকার জন্যই এ ভালোবাসা? ভালোবাসাতো ভালোবাসাই।

পিতা-পুত্র, মা-কন্যা, বন্ধু-বন্ধু, এমনকি রক্ত ও আত্মার সম্পর্কীয় সবার জন্যই ভালোবাস। তবে প্রেম ভালোবাসা বলতে সবার আগে বোঝায় প্রেমিক যুগলের ভালোবাসাকে। আর এ দিনটিকে ঘিরে প্রেমিক যুগলরা হয়ে উঠে উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত। কখনো কখনো হয়ে ওঠে বেপরোয়া। প্রেম নিয়ে যুগে যুগে হাজারো কবিতা আর গান মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাইতো লিখেছেন, মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল/কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখার প্রেমের সঙ্গে বিরহকেও টেনে এনেছেন। তিনি লিখেছেন- ঘরে ঘরে আজি কত বেদনায়/ তোমারি গভীর বিরহ ঘনায়/ কত প্রেম হায় কত বাসনায়। করি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তো লিখেই দিয়েছেন- ভালো আছি, ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো। হ্যাঁ। আগে আবেগমাখা চিঠিই ছিল ভরসা। আর এ চিঠি মনের মানুষের হাতে পৌঁছাতেও কত কসরত করতে হয়েছে প্রেমিকা-প্রেমিকাকে।

মনের মানুষকে এক নজর দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর এখন স্মার্ট ফোনে ডায়াল করলেই ওপাশে প্রেমিকা আর এপাশে প্রেমিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছে একে অপরকে দেখে। এর মাধ্যমে প্রেমের আসল যে টান তা হারিয়ে গেছে। ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, চ্যাটিং, ফোন ও মোবাইলের যুগে ভালোবাসায়ও লেগেছে যান্ত্রিক ছোঁয়া। যন্ত্রের মতোই তা কখনো কখনো বিট্রে করে। অকেজো হয়ে যায়। সে যা-ই হোক? প্রেম আসলে প্রেমই। প্রেমের সঙ্গে তুলনা হয় না কোনো কিছুরই। আর এ প্রেম নিয়ে কী ভাবছে বর্তমান যুগের প্রেমিক যুগল? সাজেদ রহমান ও শিউলি আক্তার প্রেমিক ঝুটি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের প্রেম। চার বছর প্রেমের পরে গড়িয়েছে বিয়ে পর্যন্ত। সাজেদ বলেন, ৮৯ সাল। আমি অর্নাস শেষ বর্ষে। আর শিউলি তৃতীয় বর্ষে। দুজন একই ডিপার্টমেন্টে। প্রথম দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু বলার কোনো সাহস পাচ্ছিলাম না। আমার কয়েকজন বন্ধু খুব সহযোগিতা করেছে। ততদিনে শিউলিও বুঝে গেছে আমি তাকে পছন্দ করি। দূর থেকে প্রায় সময় আমাদের চোখাচোখি হতো।

একদিন নবীন বরণে সে খুব সেজে এসেছিল। সেদিন তাকে প্রপোজ করি। যখন প্রপোজ করি, পুরো শরীর কাঁপছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি কাউকে প্রপোজ করছি। হাতের কাছে গোলাপ ছিল না, ক্যাম্পাস থেকে গাদা ফুল ছিঁড়ে দিয়েছিলাম। সেই দিন সে প্রপোজের উত্তর দিয়েছিল- এই বলে, তুমি একটা গাধা। সেদিন আর কথা বলিনি। এক সপ্তাহ পর আমার বন্ধুদের কাছে খবর পাঠিয়েছিল তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সে কি আনন্দ। এরপর আমাদের দেখা, কথা, বলা। ক্যাম্পাসে এসে একসঙ্গে আড্ডা দেয়া। ক্যান্টিনে বসা। স্টাডি করা সবই চলতো একসঙ্গে। আর দুই দিন পর পর চিঠি চালাচালি তো ছিলই। এখনো চিঠিগুলো আমাদের কাছে আছে। তবে বিয়ের ব্যাপারে প্রথমে পরিবার মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু আমরা ধৈর্য হারাইনি। যখন দুজনের চাকরি হলো বিষয়টি পরিবার মেনে নিয়েছে।

আদিব হাসান ও নাফিসা আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ভালো বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মাঝে। পরে প্রেম এবং বিয়ে। আদিব হাসান তার ফেসবুকে স্ট্যাটসে বলেন, আমরা বিয়ে করি ২০১০ সালের মাঝামাঝি। আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। এরপর ভালো বন্ধুত্ব থেকে জীবনসঙ্গী। দুজনেই তখন মেডিসিনে এফসিপিএসের ট্রেনিং করছি। হাসপাতালে রোগী দেখতে অনেক সময় দিতে হয়। মাস চারেক পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রায়ই জ্বর আসতো, তখন ধারণা করেছিলাম কাজের চাপে এমন হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছিল। ১০৪-১০৫ ডিগ্রি জ্বর উঠে যাচ্ছিল, সঙ্গে ইউরিনারি রিটেনশনও দেখা দেয়। কোনোভাবেই ডায়াগনোসিস করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। কথা জড়িয়ে যেত, সঙ্গে মেমোরি লস দেখা দেয়। কাছের মানুষদেরও চিনতে পারতাম না, এমনকি আমার স্ত্রীকেও না। ২০১২ সালে এই অবস্থা আরো অবনতি হয়েছে।

আমার বর্তমান যে শারীরিক অবস্থা, তাতে আবার পূর্বের মতো হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান হলো অসুখটা ও সিমটমগুলো যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা। আমি যে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি তাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আমার স্ত্রীর ও আমার বাবা-মায়ের। আমার বাবা-মাও একই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এবং তাঁরাও একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেন। মাঝখানে প্রায় দুই বছর আমি পুরোই বিছানায় ছিলাম। নিজে উঠে বসতে পারতাম না, বাইরের আলো বাতাস পর্যন্ত দেখিনি। এসময় নাফিসার যত্ন আর সঙ্গই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। অনেক ভেবে ওকে আমি বলেছিলাম যে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে। কারণ আমি মাঝখানে কয়েকবার মৃত্যুর সম্মুখীন হই। আমার যে শারীরিক অবস্থা তাতে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশা ছিল না। কিন্তু নাফিসা আমাকে ছেড়ে যায়নি।

ভালোবাসা যে সব প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে নাফিসাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। প্রেম আছে যেখানে বিরহ সেখানে থাকবেই। তাইতো যুগে যুগে প্রেম বিরহ পাশাপাশি চলে আসছে। হাজারো প্রেম কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভালোবাসা বা প্রেম স্বর্গ থেকে আসে। এ কথাটাই মনে করেন খাঁটি প্রেমিক যুগল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, আগের সম্পর্কগুলো দীর্ঘমেয়াদি ছিল। এখনকার সম্পর্কগুলোর মধ্যে সেটা নেই। তবে আমার কাছে মনে হয় সেটার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে হচ্ছে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়া। প্রযুক্তির কল্যাণের কারণে মানুষ এখন পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাছাড়া এখনকার তরুণ-তরুণীরা পড়াশোনার পাশাপাশি নানান কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছে। ফলে অনেকের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হচ্ছে, বন্ধুত্ব থেকে তারা সম্পর্কে যাচ্ছে আবার সেখানে থেকে ফিরে আবার বন্ধুত্বে আসছে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের নিজেদের সম্পর্কগুলো বুঝতে না পারা। তারা বোঝে না কোনটা প্রেম বা কোনটা বন্ধুত্ব।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button