কোভিড-১৯: গাজীপুরেও লাশ দাফনে এগিয়ে এসেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কোভিড-১৯ আতঙ্কে পরিবারের সদস্যরা যখন লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন বা ভয়ে দূরে থাকছেন, তখন মরদেহকে শেষ বিদায় জানাতে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সম্মানজনক ভাবে দাফন করে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা।
কখনও মুসলিম দাফন, কখনও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকার, কখনও বৌদ্ধদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কখনওবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোককে সমাধিস্থ করা- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবী দল।
যার যার ধর্মমতে শেষবারের মতো সম্মানের সাথে সম্পন্ন করছেন মরদেহের শেষকৃত্য। গত ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে সর্ব ধর্মীয় মানুষের শেষযাত্রার সেবায় চলছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এ দাফনসেবা। বর্তমানে গাজীপুরেও মরদেহ দাফনে এগিয়ে এসেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
শুক্রবার (২৬) জুন পর্যন্ত গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে দশ জনের অধিক দাফন সম্পন্ন করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী দল।
সর্বশেষ শুক্রবার (২৬ জুন) বিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী কালীগঞ্জের ফুলদী গ্রামে দাফন করা হয় কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মরতকে (৬৯)।
মৃত ওই ব্যক্তি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নিয়ন্ত্রক বিভাগে প্লান্ট অপারেটর হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালে অবসর নেন।
মৃত ব্যক্তির ছেলে বলেন, ‘করোনা উপসর্গ নিয়ে গত ১৪ জুন প্রথমে বাবাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের আইসোলেশনে ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়া হয়। এরপর ১৮ জুন কোভিড-১৯ নেগেটিভ রিপোর্ট পেলে হাসপাতাল থেকে বসায় নিয়ে আসি। পরবর্তীতে পূণরায় অসুস্থতা অনুভব করলে ১৯ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য দ্বিতীয়বার নমুনা দেওয়া হয়। ২৩ তারিখে কোভিড-১৯ পজেটিভ রিপোর্ট পেলে বাবাকে কোভিড ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ২৬ জুন শুক্রবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যায়’।
তিনি আরো বলেন, বাবার লাশ দাফনের জন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করলে দ্রুততম সময়ে কোয়ান্টামের প্রশিক্ষিত দাফন টিম লাল নিয়ে কালীগঞ্জের ফুলদী গ্রামে আমাদের বাড়িতে পৌঁছায় শুক্রবার বিকেলে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে গোসল, জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবকরা।
কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান আখন্দ ফারুক বলেন, ‘বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মরতার লাশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী শুক্রবার বিকেলে কালীগঞ্জের ফুলদী গ্রামে দাফন সম্পন্ন করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবকরা’।
এর আগে গত ২৫ জুন গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের দড়িবলধা গ্রামের এক ব্যক্তি (৬৩) কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়ে মারা যান। বেশ কিছুদিন তিনি কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত ১৭ জুন কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। এরপর ২১ জুন রিপোর্টে কোভিড-১৯ পজেটিভ শনাক্ত হন। ২৫ জুন সকালে তিনি নিজ বাড়িতে মারা যায়। পরে বিকেলে তাঁর দাফন সম্পন্ন করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবকদল।
গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) জালাল উদ্দিন শেখ বলেন, কোভিড-১৯ শনাক্ত ওই ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর বাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আক্তার উজ্জামান শুকুর স্বেছা দাফন কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এর দাফন টিমকে খবর পাঠান। পরে দ্রুততম সময়ের কোয়ান্টামের প্রশিক্ষিত দাফন টিম মৃত ব্যক্তির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছায় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে গোসল, জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন করেন।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন গাজীপুর শাখার অর্গানিয়ার আলীম-আল-রাজী বলেন, ধর্মীয় বিধান মেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা দাফন সম্পন্ন করে থাকেন। মুসলিমদের যথাযথ ধর্মীয় বিধান মেনে গোসল-অজুসহ কাফনের কাপড় থেকে শুরু করে জানাজা পড়িয়ে যথাযথ নিয়মে কবরস্থ করা হয়। মুসলিম ছাড়াও সনাতন ধর্মালম্বীদের জন্য রয়েছে আমাদের দক্ষ সনাতন দল। খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এছাড়া নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নারী দল।
আলীম-আল-রাজী আরো বলেন, করোনার এই সময়ে সারাদেশকে ২৩টি জোনে ভাগ করে চলছে কোয়ান্টামের দাফনসেবা। রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, যশোর, বগুড়া, রংপুর, পাবনাসহ দেশের যেকোনো প্রান্তের জন্য প্রস্তুত রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। প্রয়োজনে এক জেলা থেকে ওজু-গোসল ও কাফনের কাপড় পরিয়ে সমন্বয় করে অন্য জেলায় দাফনকাজ সম্পন্ন করছেন কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যরা।
শেষকৃত্যে কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবক দল মৃতের জন্য পূর্ণ মমতা নিয়ে আন্তরিক প্রার্থনা করেন। পরিবারের স্বজনদের উপস্থিতি কম বা না থাকলেও সেখানে পরিবারের একজন হয়েই মৃতকে শেষ সম্মান জানান তাঁরা।
তিনি বলেন, কোয়ান্টাম স্বেচ্ছাসেবক দলের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ অ্যাডভোকেট, কেউবা সাংবাদিক, কেউবা শিক্ষার্থী। দিনে বা রাতে যেকোনো সময় ডাক পড়লেই নানা পেশার এই স্বেচ্ছাসেবক দল হাজির হয়ে যান হাসপাতাল বা মৃতের বাড়িতে। যথাযথ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মমতা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে মৃতের আপনজন হয়েই শেষ বিদায়ের সঙ্গী হন তাঁরা।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন অর্গানিয়ার আলীম-আল-রাজী জানান, গত ৭ এপ্রিল থেকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা দেশের যেকোনো প্রান্তে করোনায় মৃতদের সমাহিত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন সংগঠনের ছয় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। গত ২৬ জুন পর্যন্ত গাজীপুর জেলায় দশ জনের অধিক দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে।
এছাড়াও সারাদেশে ৮৪৮ জনের মরদেহ দাফন, সৎকার বা শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মুসলিম ৭১৪, সনাতন ১২২, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৯ ও খ্রিস্টান ধর্মের তিনজন।
আলীম-আল-রাজী বলেন, একটি দাফন প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩০ রকমের উপকরণ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম। দাফনকাজে সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় অ্যালকোহলসহ কয়েক ধরনের জীবাণুনাশক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী এ দাফন কার্যক্রম চলছে। কার্যক্রমের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, ফেসশিল্ড, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, হেভি গ্লাভস, নেককভার, মরদেহের কাফনের কাপড়, মরদেহ বহনের জন্য বিশেষ বডিব্যাগসহ সুরক্ষার জন্যে কয়েক ধরনের জীবাণুনাশক- পুরোটাই কোয়ান্টামের স্ব-অর্থায়নে স্বেচ্ছাসেবায় পরিচালিত হচ্ছে।
গাজীপুর জেলায় দাফন সংশ্লিষ্ট যে কোন ধরনের সহযোগিতার জন্য যোগাযযোগ করা যাবে- কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন করোনা দাফন হটলাইন ০১৩০৬৪১৩১৬৩, ০১৭২৯২০২০২৫, ০১৭৯৯৩৫৫৬৫৫ এই নম্বরে।
এ ছাড়া কোয়ান্টামের ওয়েবসাইটেও এ সংক্রান্ত সকল তথ্য পাওয়া যাবে-http://www.quantummethod.org.bd/