আলোচিত

অবৈধ অস্ত্র কারবারিদের নতুন কৌশলে ‘বেকায়দায়’ পুলিশ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক কারবারিদের কৌশলে বেকায়দায় পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভারতে তৈরি কিংবা ভারতীয় সীমান্ত পথে যেসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশে পাচার হচ্ছে, তার কোনোটিতেই ভারতের নাম লেখা নেই। লেখা থাকে মেইড ইন ইতালি, ইউএসএ ও ইউকে। এ কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে এ বিষয়ে নালিশ করার আগে ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকের প্রকৃত হিসাব দিতে পারছে না পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদির তথ্য চেয়ে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকদের (ডিআইজি) কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধারের পরিসংখ্যান দিতে বলা হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর পুলিশের অনেক কর্মকর্তা অস্ত্র উদ্ধারের হিসাব কষে দেখছেন, অস্ত্র ও বিস্ফোরক মোড়কের গায়ে কোথাও ভারতের নামখুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো পরিসংখ্যান ফরমে ভারত থেকে পাচার হওয়া অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের তথ্য দেখাতে পারছেন না তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিবেশী একটি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে নিম্নমানের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা হয়। পরে সীমান্ত এলাকার অবৈধ কারবারিদের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পাচার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘এসব অস্ত্রের গায়ে বিভিন্ন দেশের নাম উল্লেখ করা হলেও আসলে সেই দেশের নয়। কারণ এসব অস্ত্রের মান অনেক খারাপ। দেখতে অমসৃণ। ফিনিশিং ভালো নয়। নিম্নমানের লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়। একটি বুলেট ফায়ার করার পর আরেকটি আটকে যায়।’

অস্ত্র উদ্ধারকারী ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একজন সহকারী কমিশনার বলেন, গত এক বছরে ডিবি ৬৯টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই ভারতে তৈরি। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এসেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, এ বছরের শেষ দিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় হত্যাকাণ্ড, সীমান্তে সক্রিয় বিভিন্ন অপরাধী চক্র এবং ভারতের সীমান্ত দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাচার হওয়া অবৈধ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও চোরাকারবারিদের তথ্য আদান-প্রদানের কথা রয়েছে। আর এ সম্মেলনকে সামনে রেখেই মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের কাছ থেকে ভারতীয় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহসীন রেজা বলেন, চলতি বছরের শেষের দিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। এ ধরনের সম্মেলনে সাধারণত দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা দেশ থেকে বছরে গড়ে প্রায় দুই হাজার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ অস্ত্র উদ্ধার হয়। সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্ধার হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ অবৈধ অস্ত্র। বছরে উদ্ধার হওয়া এই সংখ্যার দুই থেকে তিন গুণ বেশি অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। এগুলোর বেশিরভাগই ভারতীয় সীমান্ত পথে দেশে ঢুকছে বলে গোয়েন্দারা জানান।

পুলিশ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত এলাকায় অবৈধ কারবারিদের মধ্যে সোহেল, মোহাম্মদ আলী, কাবিল, আবদুল্লাহ ওরফে মেম্বার ও কামাল গ্রুপের অন্তত ২৫ অবৈধ অস্ত্র কারবারি সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় আবদুল্লাহ ওরফে মেম্বার। কুষ্টিয়া সীমান্ত এলাকায় মিঠু ও নিয়ামত গ্রুপের সদস্যরা অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। জয়পুরহাটের হিলি সীমান্তে সক্রিয় হাজী গ্রুপের সদস্যরা। এরা তাবলিগের বিছানায় জড়িয়ে অবৈধ অস্ত্র পাচার করে থাকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কামাল গ্রুপের নেতা সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে ফের অস্ত্র সংগ্রহে নেমেছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এখন কারবারিরা নতুন সংকেত ব্যবহার করছে। ফুলের চারা সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে অস্ত্রের সরবরাহের চাহিদা পাঠাচ্ছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পাচার হওয়া অস্ত্রের একেকটির দাম ২০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অস্ত্রের গায়ে খোদাই করে ইতালি, ইউকে ও ইউএসএ লিখে দাম বাড়িয়ে থাকে কারবারিরা।

ডিএমপির কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৮ সালে ডিএমপির বিভিন্ন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেড় শতাধিক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেন। এগুলোর বেশিরভাগই ভারতে তৈরি বলে তারা জানতে পেরেছেন। তবে ভারতে তৈরি হলেও অস্ত্রের গায়ে কোথাও ভারতের নাম উল্লেখ নেই।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারকারী একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশঘেঁষা ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্ন গহীন জঙ্গল ও পাহাড়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কারখানা আছে। এসব অস্ত্র কারখানা থেকে অবৈধ অস্ত্র সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ছে।

 

সূত্র: দেশ রূপান্তর

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button