গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা বর্তমানে ৩ কোটি ৩০ লাখ টন। এর বিপরীতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ৬ কোটি ৬০ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ায় এর অর্ধেকই অব্যবহূত থাকছে। ব্যাংকঋণের টাকায় অপরিকল্পিত এ বিনিয়োগে দেউলিয়ার ঝুঁকিতেও আছেন অনেকে।
সিমেন্টের মতোই সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছেন না ইস্পাত, চিনি ও স্পিনিংয়ের মতো ভারী শিল্পের উদ্যোক্তারা। এসব শিল্পেরও সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ অব্যবহূত থাকছে। নিয়মিত কারখানা বন্ধও করছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানির সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ভারী শিল্পে বড় বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। ব্যাংকঋণের সহজপ্রাপ্যতায় চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। এসব কারণে সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহূত থাকছে। উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে না পারায় কেউ কেউ ব্যবসা বন্ধের পাশাপাশি বিনিয়োগ নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি অনুভব করছেন।
দেশে ভারী শিল্পগুলোর অন্যতম সিমেন্ট। গত এক দশকে শুধু এ খাতেরই ৩০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন একটি কারখানা নিলয় সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ। যশোরের বসুন্দিয়ায় ২০০০ সালের দিকে সিমেন্ট কারখানা চালু করে নিটল-নিলয় গ্রুপ। সিমেন্টের পাশাপাশি কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য ২০০৭ সালে প্লান্টও বসায় প্রতিষ্ঠানটি; কিন্তু ২০১২ সালের দিকে বার্ষিক ১ লাখ ৩০ হাজার টন উৎপাদন সক্ষমতার কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বন্ধই রয়েছে।
বন্ধের কারণ জানতে চাইলে নিটল-নিলয় গ্রুপের কোম্পানি সচিব আবু জাকির আহমেদ বলেন, রেনোভেশনের কাজের কারণে আমাদের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তবে আগামী বছর আবার উৎপাদন শুরু করব।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত দেশে সিমেন্টের চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হতো আমদানির মাধ্যমে। বিনিয়োগ বোর্ডে সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে ছোট-বড় ৯৩টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন করে। এর মধ্যে ৬৩টি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপনের অনুমোদন পায় ও উৎপাদনে আসে। বর্তমানে এসব কোম্পানির মোট বার্ষিক সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা ৬ কোটি ৬০ লাখ টন। এর বিপরীতে চাহিদা ৩ কোটি ৩০ লাখ টন, যা সক্ষমতার অর্ধেক।
বিসিএমএর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শহিদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, সীমিত পরিসরে হলেও প্রতিবেশী দেশে সিমেন্ট রফতানি শুরু হয়েছে। দেশেও বর্তমানে যে হারে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে সিমেন্টের চাহিদা অনেক বাড়বে। তখন সক্ষমতা অনুযায়ী সিমেন্ট উৎপাদন সম্ভব হবে।
অপরিকল্পিত বিনিয়োগের কারণে সিমেন্টের মতোই সংকটে রয়েছে চিনি শিল্পও। উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহূত থাকায় বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে এ শিল্পের প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড। বার্ষিক প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন সক্ষমতার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি চিনি উৎপাদন করছে বর্তমানে তিন লাখ টনের মতো। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কারখানা স্থাপন করলেও মুনাফার পরিবর্তে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান এখন ৭৭০ কোটি টাকা। শিগগিরই রফতানি শুরু করতে না পারলে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কোম্পানিটি।
যদিও দেশে ব্যবসার সম্ভাবনা ও কর্মসংস্থানের চিন্তা করে এ বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দেশবন্ধু সুগারের চেয়ারম্যান মো. গোলাম মোস্তফার। তিনি বলেন, সবাই ব্যাংকঋণের মাধ্যমেই বিনিয়োগে এসেছেন। এখন সরকারের দায়িত্ব এ শিল্পকে টিকে থাকার সুযোগ করে দেয়া। সরকার নীতি সহায়তা দিলে রফতানির মাধ্যমে সক্ষমতা কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে সরকারি চিনিকল রয়েছে ১৪টি। এর বাইরে বেসরকারিভাবে চিনি পরিশোধন ও বাজারজাত করছে পাঁচটি কোম্পানি। সরকারি কোম্পানিগুলোর বার্ষিক এক লাখ টন চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাঁচ পরিশোধন কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৪৫ লাখ টন। এর বিপরীতে সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে চিনির চাহিদা ছিল মোট ২৪ লাখ টন। ব্যাংকঋণের মাধ্যমে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ নিয়ে এখন শঙ্কায় এ খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান।
বড় বিনিয়োগ করে সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহূত থাকছে ইস্পাত শিল্পেও। দেশে সিআর কয়েল ও অটো রি-রোলিংসহ চার শতাধিক কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ লাখ টন। খাতসংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এ সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহূত থাকছে। বার্ষিক গড়ে ৪০ লাখ টন পণ্য উৎপাদন করতে পারছে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এ শিল্পের অনেকেই ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ছোট কারখানা বন্ধও হয়েছে।
যদিও সরকারের বৃহৎ প্রকল্পের কারণে দেশে ইস্পাত শিল্পের সম্ভাবনা ভালো মনে করছে খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন। বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মাসুদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের দেশে ইস্পাত শিল্পে বর্তমানে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণেও যাচ্ছে। দেশে অবকাঠামো খাতে কাজ বেড়ে যাওয়ায় গত বছর ইস্পাতের ব্যবহার ৫০ লাখ টনের মতো হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে। অপরিকল্পিত বিনিয়োগে গড়ে ওঠা কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান সংকটে থাকলেও তা কেটে যাবে।
দেশের বস্ত্র খাতের বড় স্পিনিং মিলগুলোর অন্যতম মাকসুদা স্পিনিং মিলস। রফতানির পরিকল্পনায় বড় বিনিয়োগ করলেও বাজার ধরতে না পারায় লোকসানে আছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংকঋণের অর্থে কারখানা স্থাপন করে কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। ১১৯ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ খেলাপিও হয়েছে মাকসুদা স্পিনিং মিলসের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই তালিকায় আছে মাহবুব স্পিনিং, আনোয়ারা স্পিনিং, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড, এইচআর স্পিনিং মিলস, মোবারক আলি স্পিনিং মিলস লিমিটেডের মতো এ খাতের প্রতিষ্ঠান।
স্পিনিং মিলস-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্পিনিং খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ২৪ লাখ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও উৎপাদন হচ্ছে ১৪ লাখ টনের কিছু বেশি। তুলাজাত সুতা উৎপাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বলছে, তুলা থেকে পোশাকের সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং খাতের উৎপাদনক্ষমতার ৪০ শতাংশের বেশি অব্যবহূত থাকছে। ফলে বিনিয়োগ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে দেশে স্পিনিং মিল ছিল ২১টি। ২০০০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০ ও ২০১৬ সাল শেষে ৪২৪টি। এসব কারখানায় ৮৪ লাখ ৩৯ হাজার স্পিন্ডল থাকলেও এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অলস পড়ে আছে।
দেশে ভারী শিল্পে অপরিকল্পিত বিনিয়োগে ঝুঁকি দেখছেন ব্যাংকারও। বিশাল অংকের ব্যাংকঋণ নিয়ে সক্ষমতার ব্যবহার করতে না পারাকে ঋণখেলাপি হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট প্রতিষ্ঠান। আমরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এখন বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছি। গ্রুপ কোম্পানির অতীত ইতিহাস, নগদ পরিচালন দেখে বিনিয়োগ করছি। অতিরিক্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রফতানির সুযোগ থাকায় স্পিনিং নিয়ে খুব বেশি বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে না। অন্যদিকে রফতানি সম্ভাব্যতা কম থাকায় সিমেন্ট, ইস্পাত, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো শিল্পে অতিরিক্ত বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি করছে। যদিও চিনি শিল্পে এখন আর নতুন করে কেউ বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা বড় গ্রুপ ও তাদের নগদ পরিচালনটা বেশি লক্ষ রাখছি।
চাহিদার অতিরিক্ত বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষত তৈরি করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার নামে কোম্পানিগুলোকে এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারাও নিম্নমানের পণ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে ব্যাংকঋণের কারণে তা ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠছে অর্থনীতির জন্য।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চিনি, সিমেন্ট ও ইস্পাত শিল্পে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই বিনিয়োগ হয়েছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে সুরক্ষা দেয়ায় তারা না বুঝেই বিনিয়োগ করেছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে বিশ্বব্যাপী শুল্ক কমে গেলেই সংকটে পড়বে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট করবে।
সূত্র: বণিক বার্তা