রাজধানীতে ধুঁকছেন পত্রিকা হকাররা
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : এক সময় রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ছিল পত্রিকা বিক্রির দোকান। স্থায়ী এসব দোকানে পত্রিকা বিক্রি হতো। ভাসমান হকাররাও ওইসব দোকান থেকে পত্রিকা নিয়ে বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। কোনো ধরনের বিকল্প না রেখেই হঠাৎ এসব দোকান উচ্ছেদ করে সিটি করপোরেশন। এতে রাজধানীতে পত্রিকার ক্রেতা-বিক্রেতা পড়েছেন সমস্যায়। নির্ধারিত স্থানের দোকান হারিয়ে ধুঁকেধুঁকে চলছে হকার্সদের ব্যবসা। দোকান না থাকায় অনেকে প্রয়োজনে একটি সংবাদপত্র কিনতে ঘুরতে হচ্ছে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়।
পত্রিকা বিক্রেতাদের দুইটি সমিতির তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছর আগেও ঢাকায় ছিল ২০০টি স্থায়ী পত্রিকা বিক্রির দোকান। পরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এগুলো উচ্ছেদ করা হয়। এর পর থেকেই অনেক হকার মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নুরুল ইসলাম। বয়স ৭৫। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়। ১০ বছর বয়সে চাচার সঙ্গে এসেছিলেন ঢাকায়। কিছু দিন পর থেকেই চাচার সঙ্গে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন। এখনো একই কাজ করে যাচ্ছেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এরশাদ সরকারের আমলে আমরা একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছিলাম। তখন সরকার আমাদের ওপর খুশি হয়ে কিছু টাকা দিতে চায়। আমরা টাকা না নিয়ে সরকারের কাছে ঢাকার মধ্যে ২০০টি পত্রিকা বিক্রির স্টল করার দাবি জানাই। পরে সরকারের পক্ষ থেকে এতে সায় দেয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই আমি পত্রিকা বিক্রির কাজ করে আসছি। ঢাকায় যখন পত্রিকার হকারদের ২০০টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হলো। তখন থেকেই আমি মোহাম্মদপুরের বাস স্ট্যান্ডের পাশে পত্রিকা বিক্রি করে আসছি। দুই বছর আগে আমাদের এই দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। একদিন আমার দোকানে পুলিশ এসে বলে আপনার দোকান বন্ধ করেন। তারা আমাকে কিছু কাগজ দেখায় যেখানে একটা লেখা ছিল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম। এর পর থেকে আমার কোনো স্থায়ী দোকান নাই। আগের দোকানের জায়গায় কোনো মতে প্রতিদিন কিছু পত্রিকা বিক্রি করে জীবন চালাই। এই সামান্য ইনকামে আমার পরিবার চালাতে খুব কষ্ট হয়। আমাদের আবারো স্টলগুলো নির্মাণের জন্য আমি সরকারে কাছে দাবি জানাচ্ছি।
এই বিষয়ে ঢাকার পুরাতন হকার সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল বলেন, ঢাকা শহরে আমাদের ২০০টি পত্রিকা বিক্রির স্টল ছিল। কিন্তু গত আড়াই বছর আগে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বন্ধ করা হয়। প্রত্যেকটি দোকানের সালামিস্বরূপ সিটি করপোরেশনের কাছে ২০ লাখ টাকা জমা রয়েছে আমাদের। নতুন করে এই স্টলগুলো আবার চালু করার জন্য সিটি করপোরেশন বরাবর আবেদন করে আসছি। কিন্তু এর কোনো ফল পাচ্ছি না। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা যেতে পারলে হয়তো একটা সমাধান তিনি করে দিতেন। স্টলগুলো বন্ধ হওয়ার পর প্রায় কয়েক শ’ হকারের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমাদের এখন দাবি ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২৫০টি পত্রিকা বিক্রির স্টল পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক।
তিনি বলেন, স্টল উচ্ছেদের ফলে হকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে। এতে দৈনিক পত্রিকাগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে।
মালিবাগ এলাকার হকার ফরিদ বলেন, এই এলাকায় একাধিক স্টল ছিল। এসব স্টলে পত্রিকা ও ম্যাগাজিন বিক্রি হতো। আশপাশের কেউ প্রয়োজন হলে এসব স্টল থেকে পত্রিকা কিনে নিতো। এখন চাইলেই কেউ পত্রিকা পায় না। আগে থেকে হকারকে বলে রাখতে হয়।
মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় পত্রিকা বিক্রি করেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, আগে স্টল ছিল। এখন রাস্তায় বসে বিক্রি করি। রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট করতে হয়। এ ছাড়া স্থায়ী দোকান না থাকায় ভাসমান হকারদেরও পরিচালনা করা যায় না।
বনানী এলাকায় একাধিক স্থায়ী দোকান ছিল। এখন প্রধান সড়কের পাশে অস্থায়ীভাবে কয়েকজন দোকান বসিয়ে পত্রিকা বিক্রি করেন। তাদের একজন ফয়সল জানান, অস্থায়ীভাবে পত্রিকা বিক্রিতে সমস্যা হয়। বেশি সমস্যা হয় বর্ষার সময়। বৃষ্টি হলে দোকান নিয়ে বসা যায় না। তখন অনেক পাঠকের হাতে পত্রিকা দেয়া যায় না। তিনি বলেন, অস্থায়ী দোকান বসাতেও বাধা দেয়া হয়। পত্রিকার দোকান বলে কেউ ছাড় দেয় আবার কেউ ছাড় দেয় না।
এদিকে আগে পত্রিকার স্টল ছিল এমন অনেক জায়গা ঘুরে দেখা গেছে এখন আর ওইসব এলাকায় পত্রিকার কোনো দোকান নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে একটি দোকান ছিল পত্রিকার। এখন ওই এলাকায় আর কোনো দোকান নেই। জাতীয় জাদুঘরের বিপরীত পাশে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের নিচ তলায় ওষুধের দোকানের সামনে কয়েকজন হকার অস্থায়ীভাবে পত্রিকা বিক্রি করছেন এখন।
এদিকে হকার্স সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, পত্রিকার স্থায়ী দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক হকার কাজ হারিয়েছে। ওইসব দোকান থেকে ভাসমান হকাররা পত্রিকা নিয়ে বিক্রি করতো। এ ছাড়া অস্থায়ী দোকান বসাতেও বাধা দেয়ার কারণে রাজধানীতে পত্রিকার বাজার ছোট হয়ে আসছে। এতে হকারদের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আড়াই বছর আগে সড়কের পাশে বা ফুটপাতে থাকা পত্রিকার দোকানগুলো সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়েছে। শুধু পত্রিকার দোকান নয়, রাস্তায় যত ধরনের অবৈধ স্থাপনা ছিল সবগুলোই ইতিমেধ্য উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর এখনো যেগুলো রয়েছে সবগুলোর কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। পত্রিকা হকার সমিতির পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে দোকান পুনঃনির্মাণের জন্য আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমি এই বিষয়ে কোনো কিছু জানি না। ব্যক্তিগতভাবে দুই একজন আবেদন করলে করতেও পারেন।
সূত্র: মানবজমিন