জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়া ধর্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
গাজীপুর কণ্ঠ : গত বছরের ৯ মে মামলার নথি জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়া ধর্ষক বিল্লাল ভূইয়া (৫৫) নামে এক ব্যাক্তিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ে একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম,এল, বি মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ ওই আদেশ দেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত বিল্লাল ভূইয়া শ্রীপুর উপজেলার চিনাশুকানিয়া গ্রামের মৃত রহম উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে। রায় ঘোষণার সময় আসামী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী বিল্লাল ভূঁইয়ার বসতবাড়ির দিকে খেলতে যায়। এ সময় বিল্লাল ভূঁইয়া তার ঘরের মেঝে ঝাড়– দেয়ার জন্য ওই ছাত্রীকে ডাকে। ছাত্রীটি ঘরের মেঝে ঝাড়– দেয়ার সময় বিল্লাল ভূইয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে ছাত্রীর মুখ চেপে ধরে তাকে ধর্ষণ করে এবং ঘটনাটি প্রকাশ না করতে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
ছাত্রীটি বাসায় ফিরে ঘটনাটি তার চাচীকে জানায়। চাচীর মাধ্যমে ভিকটিমের মা ঘটনাটি জেনে ২১ সেপ্টেম্বর তিনজনকে আসামি করে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন।
তদন্ত শেষে পুলিশ বিল্লাল ভূইয়াকে অভিযুক্ত করে একই বছরের বছরের ১৭ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অপর দুই আসামিকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয় পুলিশ।
শুনানী ও স্বাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মঙ্গলবার আদালত ওই রায় প্রদান করেন।
উল্লেখ্য: ঘটনার পর থেকেই আসামি বিল্লাল ভূঁইয়া পলাতক ছিল। সে পলাতক অবস্থাতেই গত বছরের ১৭ নভেম্বর মামলায় চার্জশিট দেয় পুলিশ।
গত বছরের ৯ মে জামিনের আবেদনে জালিয়াতি করার মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন পায় শিশুধর্ষণ মামলার আসামি বিল্লাল ভূঁইয়া। তবে হাইকোর্টের আদেশ সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর পর আসামির জামিন জালিয়াতির বিষয়টি বিচারকের নজরে আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার জামিন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মামলার তদবিরকারককে তলব করেন আদালত।
বুধবার (৯ মে ২০১৮) বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দিয়েছিলেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম জাহিদ সরওয়ার কাজল তখন জানিয়েছিলেন, ‘মামলাটি চলমান অবস্থায় গত ১৪ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করে বিল্লাল। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরবর্তী সময়ে গত ২৪ এপ্রিল গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে জামিন আবেদন করে বিল্লাল। কিন্তু ওই আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। এরপর সেই আদেশের বিপরীতে গত ৯ মে মামলার নথি জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয় আসামি বিল্লাল ভূঁইয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্টের দাখিল করা ওই জালিয়াতের জামিন আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মেয়েটির বয়স ২১ (প্রকৃত পক্ষে ১০ বছর)। দুজন একে অন্যকে ভালোবাসে। মেয়ের মা সেটি পছন্দ করেন না। ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি। কোনও প্রমাণ নেই মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, ওই জামিনের আদেশ নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর জালিয়াতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে আসে। পরে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে বিষয়টি আমাকে জানানো হয়। আসামি শিশুটির মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ও হাইকোর্টের আইনজীবীর নাম জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে। কিন্তু আসামি এখনও বের হতে পারেনি। সে জেলেই আছে। এ অবস্থায় সবকিছু আদালতকে জানানো হলে হাইকোর্ট মামলার তদবিরকারককে রবিবার (২৭ মে ২০১৮) তলব করেন । একইসঙ্গে আগের আদেশ (জামিন) প্রত্যাহার করে আসামির জামিন বাতিল করেছেন।’
পরবর্তীতে ২৮ মে সোমবার অন্য আইনজীবীর ভুয়া আইডি ব্যবহার করে এবং জাল তথ্য দিয়ে ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন করানোর অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জালাল উদ্দিনকে দেশের সব আদালতে ছয় মাস মামলা পরিচালনা করতে পারবে না বলে আদেশ দিয়েছিলেন হইকোর্ট।
একই সঙ্গে তাকে আইন পেশায় কেন বারিত (নিষিদ্ধ) করা হবে না তাও জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের বেঞ্চ ওই আদেশ দিয়েছিলেন।
ওই আদেশের পাশপাশি ‘ভুয়া উকিল জামাল উদ্দিনে’র স্বাক্ষরের সঙ্গে আইনজীবী জালাল উদ্দিনের সইয়ের কোনো মিল আছে কী-না, এ জালিয়াতির ঘটনায় কে কে জড়িত এসব ব্যাপারে সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
উল্লেখ্য, জালাল উদ্দিন কখনও নিজেকে জামাল উদ্দিন হিসেবেও পরিচয় দেন বলে জানা গেছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম জাহিদ সরওয়ার কাজল। জামিন জালিয়াতির গল্প তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় জাল তথ্য সরবরাহ করে আসামিরা জামিন নেন। বিষয়টি ধরা পড়ার পর দেখা যায়, আসামিদের জামিন আবেদনকারী আইনজীবী হিসেবে নাম ছিল জামাল উদ্দিনের। আর আইনজীবী সমিতির যে আইডি ব্যবহার করেছেন, সেই আইডির আসল আইনজীবী হারুন-অর রশিদ। এ দুটি মামলার তদবিরকারক হিসেবে ছিলেন গাজীপুর সদরের রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নয়নপুর গ্রামের ফিরোজ মিয়ার ছেলে মো. রবিউল ইসলাম।
‘এ অবস্থায় আইনজীবী জামাল উদ্দিনের খোঁজ শুরু করি। কিন্তু ভুয়া আইডি হওয়ায় কোনো হদিস পাইনি। অবশেষে আরেকটি মামলায় মো. আরাফাত নামের এক আসামির মামলার তদবিরকারক হিসেবে রবিউল ইসলামের নাম পাওয়া যায়। ভুয়া তথ্য দিয়ে জামিন করানো দুটি ধর্ষণ মামলার তদবিরকারক এবং আরাফাতের তদবিরকারক ব্যক্তি একই। তবে আরাফাতের জামিন আবেদন দাখিলকারী আইনজীবীর নাম জালাল উদ্দিন। কিন্তু অন্য দুটি মামলায় জামাল উদ্দিন হিসেবে থাকা ওই ভুয়া আইনজীবী আর জালাল উদ্দিনের স্বাক্ষরের ভেতরে শব্দগত মিল পাওয়া যায়। আইনজীবী সমিতিতে জালাল উদ্দিনের আইডি নম্বর ৫৪৪০। এ অবস্থায় আদালত জালাল উদ্দিনকে তদবিরকারকসহ তলব করেন।’
জাহিদ সরওয়ার বলেন, তলবে জালাল উদ্দিন হাজির হলেও তদবিরকারক অনুপস্থিত ছিলেন। জালাল উদ্দিন হাজির হয়ে ঘটনার কথা অস্বীকার করেননি। তবে তিনি বলেছেন-সব কাগজপত্র দিয়েছে তদবিরকারক। তিনি কিছু জানেন না। এরপর আদালত রুলসহ আদেশ দেন।
‘আদেশে ছয় মাসের জন্য সারা দেশের আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন না জালাল উদ্দিন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রুলও জারি করেছেন। রুলে তাকে আইন পেশায় কেন বারিত করা হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি সিআইডিকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।