করোনায় অসহায়ত্ব: আজব হলেও গুজব নয়
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ : করোনা ভাইরাস তুলে ধরছে আমাদের অনেকের অসহায়ত্ব। কিন্তু এর অনেক গল্পই সংবাদমাধ্যমে স্থান পায় না৷ এমন কিছু অসহায়ত্বের গল্প আজ তুলে ধরতে চাই আপনাদের সামনে।
এইসব গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি চাকরিতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, ফলে নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে কাহিনী ও কথোপকথন এর সবটাই সত্যি।
কদিন আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, বিষয় ছিল লকডাউন বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা না হলেও কী কারণে মানুষ রাস্তায় বের হলেও ‘মাস্ক কই, মাস্ক কই’ বলে তাদের পেটানো হচ্ছে। তার পরদিনই যশোরের এক এসি (ল্যান্ড) চার বৃদ্ধের কান ধরানোর ছবি তুলে আলোচনায় আসেন।
ছবি দেখে খুব রাগ হচ্ছিলো, তাই বন্ধু ‘কাওসার’কে ফেসবুকে নক করলাম, ‘‘কী শুরু করেছিস তোরা?” এতো দ্রুত উত্তর এলো, মনে হচ্ছিলো দীর্ঘক্ষণ ধরে এসব উত্তরই নানাজনকে সে দিয়ে যাচ্ছে। কোন বিষয়ে কথা বলছি জানতেও না চেয়ে কাওসার বললো, ‘‘খুব মেজাজ খারাপ৷ দিনের পর দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষজনকে বুঝিয়ে কাজ উদ্ধারের চেষ্টা করি, আর এদের কারণে আমাদের সব অর্জন ধুলায় মিশে যায়।’’ আমি হাজার মাইল দূরে বসেও ফেসবুকেই তার লজ্জাটা টের পাচ্ছিলাম।
কাওসারকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আচ্ছা, এই যে মানুষকে ঘরে পাঠানো, বা কোন কোন কাজে তারা বাইরে বের হতে পারবে, তোদের দায়িত্ব কী, এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা আছে? তোদের কাছ থেকে জনপ্রশাসন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে?’’ উত্তর এলো, ‘‘না।’’ তাহলে?’’ অনেক কষ্টে খুঁজেটুঁজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি গণবিজ্ঞপ্তি পাঠালো কাওসার, বললো, ‘‘এটাই মনে হয় সবশেষ পেয়েছি, কি জানি!’’
একই দিনে এক ছোট ভাই ও এক বড় ভাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন৷ তারাও এসি (ল্যান্ড) হিসেবে কর্মরত৷ ছোট ভাই রবিন বেশ আবেগ নিয়ে লেখেন, ‘‘আমি লজ্জিত৷’’ বড় ভাই জীবন তুলে ধরেন নিজের অসহায়ত্ব। তার বক্তব্য অনেকটা এমন, ‘‘একটা বাজারে মানুষ বসে চা খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে শুনে অভিযানে গিয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে গেলাম পাশের বাজারে। কিছুক্ষণ পরেই শুনি পাশের বাজারে আবার মানুষ জড়ো হয়েছে। এমন অবস্থায় আমার কী করণীয়!’’
আরেক মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা ছোট ভাই সবুজ (ইনি এখন উচ্চশিক্ষায় বিদেশে রয়েছেন) ‘পেটানো ছাড়া উপায় নাই, সুশীলেরা চুপ থাকুন, প্রশাসন ও আইনকে নিজের মতো চলতে দিন’ বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। মানুষকে পেটানোর ঘটনায় আমি অনেক কড়া ভাষায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ফলে আমি মন্তব্য করতে চেয়েছিলাম, ‘‘আইনকে নিজের মতো চলতে দেয়ার জন্যই তো পুলিশের মানুষের গায়ে হাত না তোলা উচিত, কারণ এটা বেআইনী।’’
কী মনে করে যেনো কমেন্ট আর করিনি। সম্ভবত তার অসহায়ত্বও আমাকে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু লাঠির বাড়ি না দিয়ে বিশাল অঙ্কের জরিমানা বা কারাদণ্ড দিলেই তো হয়। সেটাও সম্ভব হচ্ছে না৷ ঢাকার পাশেই এক জেলায় র্যাবের এক সাহসী কর্মকর্তা আমার বন্ধু সুমন। ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞেস করাতে সঙ্গে সঙ্গে কল করে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পেটাস ক্যান মানুষকে?’ সুমনের সরল স্বীকারোক্তি, ‘‘একদম ভালো লাগে না রে৷ চোর ডাকাত সন্ত্রাসীদের যেভাবে মন থেকে আঘাত করি, এই মানুষদের ওপর লাঠির বাড়ি দিতে একেবারেই ভালো লাগে না। কিন্তু দেখ, আজকেই একদল নারীকে আটকালাম। কেউ বের হলে পেটানো হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে তারা রাস্তায় বের হয়েছেন। আমরা এখন কী করবো?’’
আমি বললাম, ‘‘কী করবো মানে? জরিমানা কর, অ্যারেস্ট কর৷’’ সে হেসে দিয়ে বললো, ‘‘এখন র্যাবের সব সদস্যদেরও সব জায়গায় ঢুকতে দেয়া হয় না। সামাজির দূরত্ব নিয়ে এতো কড়াকড়ি। ফলে কাউকে অ্যারেস্ট করে হাজতে ঢোকানো মানে ভাইরাস নিজের বাসায় ডেকে আনা।” ‘‘তাহলে জরিমানা?’’ ‘‘আরে, যার বাসায় খাওয়ার টাকা নাই, সে দিবে জরিমানা?’’
তাহলে? এটা কি প্রমাণ হয়ে গেল যে মাইরের ওপর ওষুধ নাই? র্যাব কর্মকর্তা সুমন জানালো, কথাটা সবক্ষেত্রে সত্যি না। ‘‘আজকেই অনেককে আটকালাম, এদের অনেকেই দিনমজুর। অঘোষিত লকডাউনে দীর্ঘদিন কোনো কাজ নেই। রাস্তায় বের হয়েছে বাসায় খাবার নেই বলে। তারা শুনেছে অনেকেই রাস্তায় কাউকে পেলে ত্রাণ দিয়ে যায়।’’ ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। বেশ কড়া অফিসার বলে পরিচিত সুমনের চেহারাটাও এসময় একটু কান্না কান্না দেখালো, ‘‘এদের গায়ে হাত তুলি কিভাবে বল?’’
সারাদেশের সব কিছু ছুটি৷ কিন্তু এর মধ্যেও ব্যাংকার, ডাক্তার, সাংবাদিকরা নিয়মিত অফিস করছেন। এমনকি স্বাভাবিক আট ঘণ্টার নিয়মও এখন ভেঙেচুরে গেছে৷ এক ব্যাংকার ছোট ভাই রিপন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘‘সবাই মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই নিয়ে এতো কথা বলছেন, আমাদের ব্যাংকারদের কথা কী ভুলেই গেলেন?’’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তোমাদের তো ভাই জরুরি সেবা। টাকা না পেলে মানুষের চলবে কিভাবে?’’ তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘‘এতো কিছু জানি না ভাই, আমাদেরও তো বউ বাচ্চা আছে, আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন নাই? এতোদিন যারা ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করেছে তাদের এনে এখানে বসানো হোক।’’
সাংবাদিক এক বড় ভাই সজীব। সংবাদ প্রকাশের বাইরেও করোনা ভাইরাস নিয়ে পড়াশোনায় তিনি অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে। যেসব ভুল তথ্য ও গুজব অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে, তার বিরুদ্ধেও অন্য অনেক সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি সোচ্চার তিনি৷ সেদিন তার ফেসবুকে দেখলাম স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ পুরনো ছবি শেয়ার করেছেন। বাসায় ফিরে তিনি এখন আলাদা রুমে থাকেন, কারো আশেপাশে যান না। দুঃখ করে ফেসবুকে বলেছেন, ‘‘কবে যে আবার মেয়েদের জড়িয়ে ধরতে পারবো!’’
ডাক্তারদের ওপর এখন দেশের বড় একটা মানুষ খ্যাপা৷ সাংবাদিকদের মতোই একটা অংশের জন্য এই পেশার মানুষদেরও প্রায়ই সবার চক্ষুশূল হতে হয়। কিন্তু এর অন্যদিকও রয়েছে, অন্য কারণও রয়েছে। তবে আমার এক সহকর্মী বলছিলেন, তার ছোট বোন রাগে দুঃখে চাকরি ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন৷ কোনো রকম সুরক্ষা উপকরণ ছাড়াই তাদেরকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছিলো। লন্ডনের আরেক বন্ধুর ছোট ভাই কেবলই পড়াশোনা শেষ করে সরকারি ডাক্তার হয়েছেন। অথচ যে উপজেলায় তিনি নিয়োগ পেয়েছেন সেখানে অনেক সিনিয়র ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও তাকেই নাকি করোনা প্রতিরোধের পুরো দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার বন্ধুটি বেশ সচেতন এবং সোচ্চার। কিন্তু তিনিও দুঃখ করে বলছিলেন, ‘‘এখন মনে হচ্ছে নিজের ভাইকে ডাক্তারি না পড়ালেই ভালো হতো।’’
এতো অসহায়ত্বের শেষ আশার গল্প দিয়ে করতে চাই৷ আমার স্কুলের বন্ধু আদনান এখন সিলেটে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। সে ও তার বন্ধুরা বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের বাসায় বাসায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য নতুন একটি ওয়েবসাইট খুলেছে। সিলেটের যে ডাক্তারকেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে অনুরোধ করা হয়েছে, তারাই নাকি সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ নিয়ে রাজি হয়ে গেছেন।
এমন গল্প আমাদের অসহায়ত্বের মধ্যেও আশা জোগায়৷ করোনা আমাদের অনেক কিছু শেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমাদের যাতে আর কখনও এমন অসহায়ত্বের মধ্যে পড়তে না হয়, সে শিক্ষা আমাদের নেয়া উচিত সবার আগে।