কালীগঞ্জে রেলওয়ের সাড়ে ৩ একর জমি প্রাণ আরএফএল’র দখলে!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সিএস খতিয়ান অনুযায়ী কালীগঞ্জ পৌর এলাকার মূলগাঁও মৌজায় ৪৯ দশমিক ২৬ একর জমি ছিল তত্কালীন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের মালিকানায়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানায় আসে। তবে আরএস খতিয়ানে ওই জমির ৩ দশমিক ৫২ একর রেকর্ড হয়েছে ১৮ ব্যক্তির নামে। বর্তমানে ওই জমির ওপর প্রাণ আরএফএল গ্রুপের একটি কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে জমির ভাড়াও আদায় করছেন আরএস খতিয়ানে উল্লিখিত মালিকরা।
এছাড়াও টঙ্গী-কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল সড়ক বর্ধিত করার কাজ চলছে বর্তমান সময়ে। এতে কালীগঞ্জ অংশে রেলের জমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে রানা বিল্ডার্স নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যার সহযোগিতায় রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
অনুসন্ধান ও নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিএস খতিয়ানে মূলগাঁও মৌজায় মোট আট দাগে রেলওয়ের সম্পত্তির পরিমাণ ৪৯ দশমিক ২৬ একর। এ সম্পত্তির মধ্যে ১৪৩৯ দাগ নম্বরের ১৩ দশমিক ৩৭ একর ব্যবহার হচ্ছে রেল রাস্তা হিসেবে। এছাড়া ১৪৮৩ ও ১৬৪২ দাগের প্রায় ১১ একর সম্পত্তি রয়েছে অবৈধ দখলে। আর ১৯২১ দাগে টঙ্গী-ভৈরব রেল রাস্তা হিসেবে রয়েছে ৩ দশমিক ২৫ একর।
টঙ্গী-ভৈরব রেল রাস্তার এ জমি সিএস খতিয়ানে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের নামে থাকলেও আরএস খতিয়ানে তা চলে গেছে ব্যক্তিমালিকানায়। আরএস খতিয়ান অনুযায়ী বর্তমানে এ জমির মালিক কালীগঞ্জ বাঘারপাড়ার চান্দু ভূঞা, ছফর উদ্দিন, মমিন উদ্দিন, ওহদ আলী, কালু প্রধান, ছমেদ আলী, কেয়ামদ্দিন, রহিম উদ্দিন, দহম উদ্দিন, হাকিম উদ্দিন, জমির উদ্দিন, জালু প্রধান, মাইন উদ্দিন, মনোয়ার উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, রমিজ উদ্দিন, হাছেন আলী ও মইজ উদ্দিন। অভিযোগ উঠেছে, একই মৌজার আরো বিপুল পরিমাণ জমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ডের প্রক্রিয়া চলছে।
সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তির নামে রেকর্ড হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুরের সহকারী জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ হাসান বলেন, সরকারি সম্পত্তি কখনই ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তার পরেও কোথাও যদি সরকারি সম্পত্তি আরএস খতিয়ানে ব্যক্তিমালিকানা হিসেবে নিবন্ধিত হয়, তা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
কালীগঞ্জ ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যক্তিমালিকানায় আরএস খতিয়ানভুক্ত হওয়া মূলগাঁও মৌজার মোট সম্পত্তির মধ্যে ১৫ শতাংশ রয়েছে বাড়ি করার জমি। এ জমির সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রতি শতাংশ ৭৯ হাজার ৮৭০ টাকা। একই মৌজার ২৯ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৮ একর রয়েছে চালা জমি। এ জমির সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রতি শতাংশ ৯৫ হাজার ৯১২ টাকা। বাড়ি ও চালার জমি মিলিয়ে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়া রেলওয়ের এ জমির মূল্য ৩ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ টাকা।
কালীগঞ্জের এ জমি সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা (পশ্চিমাঞ্চল) ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ভিন্ন মালিকানায় থাকলেও আগে জমিগুলো রেলওয়ের রেকর্ডে ছিল। এ জমিগুলোর মালিকানা রেলওয়ের নামে রেকর্ডের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তবে জনবল সংকটের কারণে অবৈধ দখলে থাকা জমি ও ব্যক্তিমালিকানায় থাকা রেলের জমি উদ্ধার কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিভাগের তিন কর্মকর্তার মধ্যে দুটি পদ শূন্য। দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তাও এক মাস ধরে ছুটিতে।
এছাড়া অবৈধ দখলে থাকা জমি উদ্ধারের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় ইউএনও বা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতির কারণেও আমরা উদ্ধার তত্পরতা চালাতে পারি না।
এদিকে রেলের জমি কোনোভাবেই ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনও। তিনি বলেন, রেলের মালিকানায় থাকা জমির মালিক অন্য কেউ হতে পারবেন না। জমি রেলেরই আছে এবং থাকবে। কেউ রেলের জমি নিজ মালিকানায় নিলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
শুধু গাজীপুরের কালীগঞ্জেই নয়, সারা দেশেই রেলের জমি অবৈধ দখল ও ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নয়াপুর মৌজায় রেলওয়ের প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমি বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে বাচ্চু মিয়া নামে স্থানীয় সাবেক এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে। কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে রেলওয়ের ১ দশমিক ৭ একর জমি (দাগ নম্বর ২৫৭/৫৮) লিজ নেন বাচ্চু মিয়া। পরে সেখান থেকে তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। অন্যদিকে একই দাগে প্রায় আড়াই বিঘা জমি অবৈধ দখলে রেখেছিলেন আবু সিদ্দিক মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে সেই জমি বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
একই অবস্থা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সিলেট-আখাউড়া সেকশনের। এ সেকশনের আওতাভুক্ত ২৬টি রেলস্টেশন ও সংলগ্ন এলাকার রেলওয়ের জমি, পরিত্যক্ত আবাসিক ভবন, গুদামঘর, কার্যালয় ভবনগুলোর বেশির ভাগই অবৈধ দখলে চলে গেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, রেলের মোট জমির পরিমাণ ৬১ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ২৪ হাজার ৪৪০ একর। আর রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জমির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৪১৯ একর। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৫৮৩ একর। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৬৭০ ও পশ্চিমাঞ্চলে ২ হাজার ৯১৩ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। সংস্থাটির প্রায় ১৩ হাজার একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে লিজ দেয়া রয়েছে।
অবৈধ দখলে থাকা জমি সম্পর্কে রেলওয়ে মহাপরিচালক বলেন, অবৈধ দখলে থাকা জমিগুলোর বেশির ভাগই রেললাইনের আশপাশে। সবগুলোই উদ্ধারযোগ্য এবং উদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান। গত দুই বছরে আমরা প্রায় দুই হাজার একর জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করেছি। অবৈধ দখলে থাকা জমি সম্পর্কে আমরা সবসময় তত্পর।
সারা দেশে আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। আগামীতে আরো নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। আমরা আশা করছি, আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে রেলের সব জমি অবৈধ দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে।