ঐতিহ্যবাহী বেলাই বিল দখল করে আবাসন প্রকল্প করছে তেপান্তর হাউজিং!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুরের বেলাই বিলের উৎপত্তি চেলাই নদী থেকে। আট বর্গমাইলের বেলাই বিলে বর্ষা মৌসুমে ডাঙ্গি খনন করে মাছ ধরেন জেলেরা। আর শুষ্ক মৌসুমে চাষ হয় বোরো ধান ও রবিশস্য। সারা বছরই বিলটিতে থাকে ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা। ঐতিহ্যবাহী এ বিলেই বালি ভরাট করে প্লট আবাসন প্রকল্প করছে তেপান্তর হাউজিং কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্লট বিক্রিও শুরু হয়েছে। যদিও আইনে জলাধার ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় কয়েকটি পরিবারের কাছ থেকে বেলাই বিলের কিছু জমি কেনে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড। এরপর ২০০৮ সালের শুরুর দিকে বিলে বালি ভরাটের কাজ শুরু করে। বালি ফেলার জন্য তারা মূলত বর্ষা মৌসুমকে বেছে নেয়। কারণ বর্ষা মৌসুমে বালি ফেললে তা নির্ধারিত জমির পাশে আরো কিছু জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। পানি নেমে যাওয়ার পর বিলের যত দূর পর্যন্ত বালি দেখা যায়, তত দূর পর্যন্ত নিজেদের জমি হিসেবে পুনরায় ভরাট শুরু করে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি।
ভূমি অফিস থেকে বেলাই বিলের আরএস ও এসএ খতিয়ান তুলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি দাগে ৯ দশমিক ৭১ একর জমি তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের নামে জারি হয়েছে। এসব জমির অধিকাংশই বোরো ও আমন শ্রেণীর। কিছু রয়েছে নালা শ্রেণীর। এসব জমির শ্রেণী পরিবর্তন না করেই বালি ভরাট করে প্লট বিক্রি শুরু করেছে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড।
যদিও ১৯৭২ সালের নদী আইনের ১৩৫ নং অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ভরা মৌসুমে পানি যতদূর পর্যন্ত যাবে, তার পুরোটাই নদী বা বিলের জমি। পানি শুকিয়ে গেলে ফোরশোর ভূমি হিসেবে পূর্ববর্তী মালিক পুনরায় ওই জমির দখল পাবেন। কিন্তু সেখানে কোনোভাবেই স্থাপনা নির্মাণ বা বালি ভরাট করা যাবে না। শুধু চাষাবাদের কাজে ওই জমি ব্যবহার করা যাবে। সে হিসেবে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড আইন ভঙ্গ করে বিলের জমিতে বালি ভরাট করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কখনই উন্মুক্ত জলাধারের জমি কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে জারি হওয়ার সুযোগ নেই। এটা হয়ে থাকলে তা হবে আইনের বড় ধরনের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বিলের জমি আবাসন প্রকল্পের জন্য নামজারির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে গাজীপুর জেলা প্রশাসনও। তার পরও কীভাবে নামজারি হলো, জানতে চাইলে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব ও এলএ) সঞ্জীব কুমার দেবনাথ বলেন, যদি কেউ এমন কাজ করে থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিস্তৃত বেলাই বিলের চারপাশে গাজীপুর সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলার চার শতাধিক গ্রাম। বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, বিলের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের অংশে বালি ফেলে এরই মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে টানানো হয়েছে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের নামে সাইনবোর্ডও। বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে বাগাদুনা খাল। এ খাল থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে বালি তুলে ফেলা হচ্ছে বেলাই বিলে।
তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের হয়ে বালি ভরাটের কাজ করেছেন বি তোফাজ্জেল হোসেন, মাহা মেম্বার, হেলাল উদ্দিন ভূইয়া, মহসীন ভূইয়া, মেসার্স মুরসালিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আজিজ মিয়াসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। বালি ভরাট করা বাবদ গত বছরের ১১ জুলাই ২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। একই দিন আরেকটি বিল ভাউচারের মাধ্যমে ঠিকাদারদের আরো ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। এর ঠিক দুদিন আগে অর্থাৎ ওই বছরের ৯ জুলাই বালি ভরাটের বিল বাবদ আবাসন প্রতিষ্ঠানটি আরো ২ লাখ টাকা পরিশোধ করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বালি ভরাট বাবদ তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড ঠিকাদারদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
গ্রাহকদের কাছে প্লট বিক্রিও শুরু হয়েছে বলে জানান তেপান্তর হাউজিং কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক আবুল হোসেন। আর পরিবেশ ছাড়পত্রের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মো. আবুল বাশার বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্র এখনো নেয়া হয়নি। তবে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া যাবে।
বেলাই বিলের শিমুলিয়া গ্রামের অংশে বালি ভরাট প্রসঙ্গে গ্রামের মসজিদের ক্যাশিয়ার জাহাঙ্গীর সরকার বলেন, তাদের পূর্বপুরুষ মসজিদের জন্য বিলের মধ্যে থাকা প্রায় ৭২ শতক জমি কমিটিকে দিয়ে গেছেন। ওই জমিও দখল করে বালি ভরাট করছে তেপান্তর।
তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড বালি ভরাটের কাজ করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো ছাড়পত্র নেয়নি। এ বিষয়ে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুস সালাম সরকার বলেন, কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করে তেপান্তর হাউজিং কোম্পানি লিমিটেড বেলাই বিলে বালি ভরাট করছে বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের সত্যতা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে বর্ষা মৌসুমে ডাঙ্গি খনন করে বেলাই বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন বিলের আশপাশের চার শতাধিক গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার। পানি চলে গেলে তারাই আবার ওই বিলে বোরো, আমন ও রবিশস্যের আবাদ করেন। কিন্তু বেলাই বিলে বালি ভরাট শুরুর পর চাষাবাদের আওতা কমে গেছে। এতে করে জীবিকা সংকটে পড়েছেন গ্রামবাসী।
পৈতৃক সূত্রে বেলাই বিলে দেড় বিঘা জমি পেয়েছেন পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামের আলম সরকার। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে ওই জমিতে চাষাবাদ আর ভরা মৌসুমে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। কিন্তু বিলে বালি ভরাট শুরুর পর থেকে সেখানে আর চাষ করতে পারছেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে এ কৃষক বলেন, পানি শুকিয়ে গেলে বিলের উর্বর মাটিতে ভালো ফসল হতো। কিন্তু বালি ভরাট করার ফলে সেখানে আর পলি জমে না। ফসলও সেভাবে হয় না।
উন্মুক্ত জলাধারে বালি ভরাট করায় সেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে আসছে। ফলে বিলের আশপাশের গ্রামগুলোয় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, যত বর্ষাই হোক, বেলাই বিলের আশপাশের গ্রামে আগে কখনই জলাবদ্ধতা হতো না। কিন্তু বিলের একটি অংশে বালি ভরাট করার পর সেখানে পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে গ্রামগুলোয় এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।