আলোচিতশিক্ষা

এক শিক্ষকেই চলছে সাড়ে সাতশ প্রাথমিক বিদ্যালয়

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার প্রায় শতভাগ। যদিও এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত শিক্ষক। গড়ে তোলা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ফলে প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই শিশুদের বড় একটি অংশ ঝরে পড়ছে। 

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার মেকুরের আলগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ব্রহ্মপুত্রের চরে গড়ে ওঠা এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দুইশ। তাদের পাঠদানের জন্য সহকারী শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। প্রধান শিক্ষকের পদটিও ছয় মাস ধরে শূন্য পড়ে আছে। পাশের উপজেলা চিলমারীর খেরুয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদানে মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন বিদ্যালয়টিতে।

মেকুরের আলগা ও খেরুয়ারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, দেশে সাড়ে সাতশ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই সবক’টি শ্রেণীর পাঠদান, পরীক্ষা নেয়া, খাতা দেখাসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েই।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ বার্ষিক অগ্রগতি প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯’-এর তথ্য বলছে, মাত্র একজন শিক্ষকেই চলছে দেশের ৭৪৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। দুজন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে—এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা এক হাজার ১২৪টি। আর তিনজন শিক্ষকে পরিচালিত বিদ্যালয় রয়েছে চার হাজার আটটি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, একজন-দুজন শিক্ষক দিয়ে একটি বিদ্যালয় পরিচালনা খুবই কঠিন। তিনজনের কম শিক্ষক দিয়ে তো কোনোভাবেই পাঠদান চালিয়ে নেয়া সম্ভব না। সরকার প্রতি বছরই শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কাজ হলো শিক্ষক সংকটে থাকা বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের পদায়ন করা। সেটি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে এ সংকট তৈরি হতো না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক সংকট কমবেশি সারা দেশেই রয়েছে। তবে চর ও হাওড় অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে এ সংকট প্রকট। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এসব বিদ্যালয়ে পদায়ন নিতে চান না শিক্ষকরা। নিয়োগের সময় অনেককে এসব প্রত্যন্ত এলাকায় পদায়ন দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে বদলি হয়ে চলে যান অন্য বিদ্যালয়ে। এর ফলে বছরের পর বছর শিক্ষকের সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এসব বিদ্যালয়কে। এতে করে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের পাঠদানও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

একজন শিক্ষক দিয়ে কীভাবে একটি বিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে তা জানতে সম্প্রতি কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে শিক্ষক সংকটে থাকা এসব বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রমের দুর্দশার চিত্র উঠে আসে।

এমন একটি বিদ্যালয় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মশালের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক থাকলেও কোনো সহকারী শিক্ষক নেই। গত মঙ্গলবার সকালে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে আসেননি। দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠদান দিচ্ছেন দপ্তরি। প্রথম শ্রেণীর পাঠদান দিচ্ছে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রী। আর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের পড়াচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর আরেক ছাত্রী।

বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না প্রধান শিক্ষক। তাই দপ্তরি ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই চলে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। বিদ্যালয়ের দপ্তরি সাইদুর রহমান জানান, জরুরি কাজ থাকায় প্রধান শিক্ষক আজ আসেননি। আমি মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেছি। স্যার না এলে আমাকে ক্লাসগুলো চালিয়ে নিতে হয়।

দপ্তরির মাধ্যমে জানতে পেরে সেলফোনে যোগাযোগ করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। তিনি জানান, আত্মীয়ের মৃত্যুর কারণে তিনি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। এছাড়া দূরত্বের কারণে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না বলেও জানান এ শিক্ষক।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, শিক্ষা কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত মনিটরিং না থাকায় একমাত্র শিক্ষকও নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উলিপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. মোজাম্মেল হক শাহ বলেন, আমার উপজেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদ রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে পাঁচটি খালি। মাত্র দুজন অফিসার দিয়ে উপজেলার ৬৪টি বিদ্যালয় নিয়মিত পরিদর্শন কতটুকু সম্ভব? আর স্কুলগুলো এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে একদিনে একাধিক স্কুল পরিদর্শনও কষ্টসাধ্য।

একই ইউনিয়নের মেকুরের আলগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও পাঠদান কার্যক্রমের একই চিত্র পাওয়া যায়। বিদ্যালয়টিতে কর্মরত একমাত্র শিক্ষক পাঠদান করছিলেন পঞ্চম শ্রেণীতে। একই সময়ে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াচ্ছিল চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্র। আর চতুর্থ শ্রেণীতে কোনো শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মাঠে খেলাধুলা করছে।

বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির একমাত্র শিক্ষক সাদিকা বেগম বলেন, গত বছর প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এখন তিনি নেই। আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে। পাঠদান কার্যক্রমের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। কোনোভাবে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। শিক্ষক সংকটের বিষয়টি উপজেলা অফিসের স্যারদের অনেকবার জানানো হয়েছে। সর্বশেষ নিয়োগের সময়ই এখানে শিক্ষক পদায়নের জন্য অনুরোধ করেছি। এর পরও কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি।

এদিকে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলেও শিক্ষক সংকটে থাকা বিদ্যালয়গুলোতে তাদের পদায়ন করা হচ্ছে না। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন নিয়োগ পাওয়া ১৬৫ জন সহকারী শিক্ষককে বিভিন্ন স্কুলে পদায়ন করে কুড়িগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। যদিও একজন বা দুজন শিক্ষক রয়েছেন এমন বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের পদায়ন করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, পদায়নের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাদের পছন্দমতো স্কুলের জন্য তদবির করেন। আর সে আলোকেই করা হয়েছে পদায়ন। যদিও শিক্ষক সংকটে থাকা বিদ্যালয়গুলো অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুড়িগ্রামের একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা শূন্য পদের তালিকা পাঠিয়ে যেসব বিদ্যালয়ে সংকট সেসব বিদ্যালয়ে পদায়ন করার জন্য অনুরোধ করেছি। পদায়নের পর দেখতে পেলাম যেখানে শিক্ষক নেই, সেখানে দেয়া হয়নি। উল্টো যেখানে শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে আরো পদায়ন দেয়া হয়েছে। জেলা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের তদবিরে এসব পদায়ন করা হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘শূন্য পদগুলো আমি ভালোভাবে খেয়াল করিনি। ব্যস্ত থাকায় পদায়নের সময় আমি অফিসে তেমন সময় দিতে পারিনি। এগুলো চেক করে পুনরায় পদায়ন দেয়া হবে।’

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস ২০১৯ অনুযায়ী, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৯ হাজার ২৪১টি, এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৭৮০ জন। এর বাইরে নতুন করে জাতীয়কৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২৬ হাজার ৩১৬টি, এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৩ জন।

 

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button