আলোচিত

পল্লবী থানায় ‘অর্থ লেনদেনেই’ হয় সব!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রাজধানীর থানাগুলোর সেবার মান বাড়াতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে নগরবাসীর আস্থার ক্ষেত্র তৈরি করছে। তবে পুলিশ কমিশনারের গৃহীত পদক্ষেপ যথাযথভাবে অনুসরণ না করার অভিযোগও রয়েছে বেশকিছু থানার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আলোচনায় পল্লবী থানা। থানাটি স্বেচ্ছাচারিতার দুর্গ হয়ে উঠেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অর্থের বিনিময়ে মাদককারবারি ও দাগি আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার মরদেহ দাফন হচ্ছে মামলা-ময়নাতদন্ত ছাড়াই। রহস্যজনকভাবে একাধিক সুরতহালও তৈরি করা হচ্ছে এক লাশের!

আদালতের বিচারিক অনেক কাজ হচ্ছে থানায় বসে। লাশের মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে টাকার অঙ্কে। মামলা-জিডি দায়ের করতে এসে তা না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। এ অবস্থায় গোপন লেনদেন-সমঝোতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক ঘটনা। এসব ঘটনা সম্পর্কে পল্লবী থানার ওসি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।

পল্লবীর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারিকে বিপুল মাদকসহ গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করেন এসআই মো. শরীফ ও তার টিমের সদস্যরা। ভয়ভীতি দেখিয়ে গ্রেপ্তার সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা হাতিয়ে মধ্যরাতেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরদিন ডিএমপি সদর দপ্তরে এ ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ দায়েরে উদ্যত হন সাহাবুদ্দিন।

পাশাপাশি সাহাবুদ্দিন বিষয়টি জানান তার অনুগত পল্লবী থানার এএসআই মাহফুজকে। তিনি বিষয়টি জানান ঘুষ গ্রহণকারী এসআই শরীফকে। ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে জানতে পেরে চাকরি হারানোর ভয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার আরেক এএসআইয়ের মাধ্যমে সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে নেওয়া ঘুষের অর্থ তাকে ফিরিয়ে দেন।

সাহাবুদ্দিন সাজাপ্রাপ্ত হলেও পুলিশের ‘ভুলে’ তার স্থলে বিনাদোষে ৪ বছর ধরে জেলে আছেন পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমান হোসেন। শুধু পিতার নামে মিল থাকায় এসআই রাসেল ও তার সঙ্গীরা আরমানকে গ্রেপ্তার করে শাহাবুদ্দিন নামে আদালতে সোপর্দ করেন। অসুস্থ মৃগীরোগী আরমানকে মুক্ত করতে এখন আদালত এবং প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তার মা বানু খাতুন ও স্ত্রী বানু বেগম।

আরমানের কারাভোগের বিষয়ে গত বছর ১৮ এপ্রিল ‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয় গণমাধ্যমে । প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৩ এপ্রিল আমরান হোসেনের কারাবন্দি বিষয়ে আদালত রুল জারি করেন। এ ছাড়া আমরানের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ জবাব চান আদালত।

এদিকে ঘটনার বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (দপ্তর)। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ঘটনায় দায়ী ৩ পুলিশের একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। অন্যজনকে করা হয় বরখাস্ত। রহস্যজনকভাবে আরমানকাণ্ডের তদন্তকালীন সময়েই প্রধান অভিযুক্ত (ওয়ারেন্ট তামিল টিমের প্রধান) এসআই রাসেল পদোন্নতি পেয়ে হন পরিদর্শক। এ নিয়ে বরখাস্ত হওয়া এসআই সম্প্রতি একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ডিএমপি সদর দপ্তরে।

সাহাবুদ্দিনকে ধরেও ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলামকে জানান এই প্রতিবেদক। খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে পরদিন ওসি জানান, সাহাবুদ্দিনকে ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এর একদিন পর ওসি নজরুল ইসলাম জানান, মাদক ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিনকে সাভার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে।

গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পল্লবী ১২ নম্বর সেকশনের উত্তর কালশীর ইদ্রিসের টেকে হাসি বেগম নামে মপ গৃহবধূকে মারধর করা হয়। রহস্যজনক কারণে ঘটনার পর থেকে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি করতে থাকে। হাসপাতালে ৫ দিন চিকিৎসাধীন পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। বিকালে হাসির স্বামী হেলাল উদ্দিন থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও মামলা নেয়নি পুলিশ। এমনকি ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরদিন ওই নারীর লাশ দাফন করা পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। ঘটনা জানাজানি হলে চাপের মুখে ৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা মামলা নিতে বাধ্য হয় পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে কবর থেকে হাসির গলিত লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়।

প্রথমে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গৃহবধূ হাসির লাশ কেন ময়নাতদন্ত হয়নি- পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, ওই নারীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি। তাই বিষয়টি অবগত ছিলাম না। অথচ গত ৫ ফ্রেব্রুয়ারি রাতে প্রতিবেদক মোবাইল ফোনে তাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। সেটি স্মরণ করিয়ে দিলে ওসি বলেন, তখন বিষয়টি আমলে নিইনি!

হাসি হত্যামামলার বাদী হেলাল উদ্দিন বলেন, আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। কিন্তু পুলিশ কেন তাদের ধরছে না।

গত ৯ জানুয়ারি পল্লবীর সেকশন-১২, ডি-ব্লকের ৩৯ নম্বর বাসায় রহস্যজনক মৃত্যু হয় গৃহবধূ শাহানাজ বেগমের। তার বাবা নিরাপত্তাকর্মী মো. আবুল কালাম মোল্লার অভিযোগ, যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় শাহানাজকে তার স্বামী তরিকুল ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন ও গুল খাইয়ে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজায়। তিনি ঘটনার পরদিন হত্যা মামলা করতে লিখিত অভিযোগ দেন পল্লবী থানায়। কিন্তু তার অভিযোগও গ্রহণ করেনি পুলিশ।

যৌতুকের কারণে স্ত্রীকে মারধর করে গুরুতর আহত করার অভিযোগে ১২ দিন আগেই বিআরটিএর দালাল সেলিমকে আটক করেন এসআই এনামুল। ওই গৃহবধূ থানায় মামলা করতে গেলেও তার মামলা নেওয়া হয়নি। উল্টো অভিযুক্ত সেলিমকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ওয়ালটন ও ফ্রেশ ছাড়াও বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৭টি মামলা রয়েছে মাসুদ রানা নামে এক প্রতারকের বিরুদ্ধে। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রক্ষিতে ৯ ফেব্রুয়ারি পল্লবীর অরজিনাল-১০ থেকে কর্তব্যরত এক সার্জেন্টের সহযোগিতায় মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন সকালে অন্য আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নেওয়া হলেও ভিআইপি এ আসামিকে নেওয়া হয় তার ব্যক্তিগত গাড়িতে।

এর আগে সেই গাড়িতে পুলিশের হেফাজতেই আসামি মাসুদ তার ব্যক্তিগত গ্রামীণফোন নম্বর থেকে সাবেক গাড়ি চালক মো. মন্টু মিয়াকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। মন্টু কৌশলে মাসুদকে ধরিয়ে দিয়েছে- এ সন্দেহ থেকে হুমকি দেওয়া হয় বলে জানান গাড়িচালক মন্টু। তিনি বলেন, হুমকির বিষয়ে জিডি করতে পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলাম। অভিযোগ পড়ে দায়িত্বরত পুলিশ বলেন, পুলিশ হেফাজতে আসামি কাউকে হুমকি দিয়েছে- এ জিডি নিলে আমাদের চাকরি থাকবে না। তাই জিডি নেওয়া সম্ভব নয়।’

এ অভিযোগের বিষয়ে পল্লবী থানার ওসি বলেন, থানায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

এদিকে পল্লবী থানা পুলিশের বেতনভুক্ত রাইটাররাও হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। থানার আশপাশে গড়ে ওঠা কয়েকটি দোকান ও ঘরে ওই রাইটারদের নির্ধারিত টাকা দিয়ে তবেই মামলা বা জিডি লেখানো সম্ভব হচ্ছে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে।

গত ২৫ জানুয়ারি পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের ১২ নম্বর হোল্ডিংয়ে অবস্থিত পাঁচতলা ভবনের সামনে থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ডরথী বাড়ৈ নামে এক গৃহবধূকে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, ডরথী ছাদ থেকে পড়ে যাননি, তাকে মদ্যপ স্বামী মার্টিন কেপি দাস হত্যা করে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়েছে। এদিকে ডরথীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর ঘটেছে আরেক রহস্যজনক কাণ্ড।

লাশ একটি হলেও সুরতহাল প্রতিবেদন হয়েছে দুটি। প্রতিবেদন দুটি ২৫ জানুয়ারি রাত ৮টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে করা হয়েছে। নজিরবিহীন এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন পল্লবী থানার এসআই মো. মোরশেদ আলম। দ্বিতীয় সুরতহাল প্রতিবেদনে এসআই মোরশেদ উল্লেখ করেন- লাশের মাথার পেছনে ডান পাশে ফোলা জখম রয়েছে। নাক, মুখ ও কান স্বাভাবিক। দাঁত বন্ধ।

আগের সুরতহাল প্রতিবেদনে ‘গলায় কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই’ লিখলেও পরেরটিতে লেখেন- ‘গলার বাম পাশে ছোলা দাগ রয়েছে। মুষ্টি খোলা দুই হাত শরীরের সঙ্গে লাগানো।’ এ ধরনের আরও অসঙ্গতি লক্ষ করা গেছে ডরথীর লাশের দুই সুরতহাল বিশ্লেষণ করে।

দুই সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী এসআই মোরশেদ আলম অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে উল্টো প্রশ্ন রাখেন- এক লাশের দুই সুরতহাল করা হয় নাকি? অবশ্য দুটি সুরতহাল প্রতিবেদনের কপিই রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে।

 

 

সূত্র: আমাদের সময়

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button