পুলিশের ‘সোর্স মানি’, বেশিরভাগই যায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পকেটে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অপরাধ ও অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহে নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এই পুরনো পদ্ধতি ছাড়াও বর্তমানে পুলিশ ডিজিটাল সোর্স ব্যবহার করছে। এসব সোর্সের পেছনে টাকা খরচ করতে হয়। সরকার থেকে এজন্য পুলিশকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘সোর্স মানি’ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই টাকা থানার উপ-পরিদর্শক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাওয়ার কথা। কিন্তু, বছরের পর বছর পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই এই ‘সোর্স মানি’ নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ‘সোর্স মানি’ না পেয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য থানার কর্মকর্তারা বিভিন্ন উপায়ে টাকা সংগ্রহ করেন। এজন্য থানাগুলোতে রেজিস্টার (খাতা) ব্যবহার করা হয়। পুলিশের ভাষায় এটাকে ‘ফাইল’ করা বলে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলার আকৃতি কিংবা মামলার অপরাধের ভিত্তিতে সোর্স মানির পরিমাণ কম-বেশি হয়ে থাকে। বড় জেলার জন্য বছরে ১০-১২ লাখ এবং ছোট জেলার জন্য বছরে ৮-১০ লাখ টাকা সোর্স মানি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই সোর্স মানির বরাদ্দ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ আছে, কোনও কোনও জেলার পুলিশ সুপার সোর্স মানি কখনও জুনিয়রদের হাতে দেন না। নিজেই পুরো টাকা রেখে দেন। তবে পছন্দের কর্মকর্তাদের কিছু টাকা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এই টাকা পান না।
২০১৯ সালের পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। দাবি তোলা হয়, অপারেশনের সঙ্গে যারা জড়িত কেবল তাদের নামেই সোর্স মানি বরাদ্দ হোক। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সম্প্রতি অপারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নামে সোর্স মানি বরাদ্দের নির্দেশ দেন।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বোয়ালিয়া থানার উপ-পরিদর্শক ইফতেখার মো. আল আমিন বলেন, ‘আগে আমরা সোর্সদের জন্য কোনও টাকা পেতাম না। এখন সরাসরি না পেলেও ওসি স্যারের মাধ্যমে কিছু পাই। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন ছোট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া দাগী আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষকে পুলিশ সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। তথ্যের বিনিময়ে এই সোর্সদের টাকা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত। পুলিশ সদর দফতর থেকে যখন এই টাকা দেওয়া হয়, তখন তা ‘অপারেশন মানি’ হিসেবে উল্লেখ থাকে।
পুলিশ সদর দফতরে কর্মরত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তথ্যের বিনিময়ে টাকা দেওয়া পুরনো পদ্ধতি। সারা বিশ্বেই এটা প্রচলিত রয়েছে। তথ্যের গুরুত্ব অনুসারে সোর্সরা বিভিন্ন পরিমাণে টাকা দাবি করে থাকে, কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকে গুরুত্ব বুঝে সোর্সকে টাকা দেওয়া হয়।’
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিদর্শক। তিনি বলেন, ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির সোর্স রয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরির সোর্সরা অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ‘বি’ ক্যাটাগরির সোর্সরাও দায়িত্ব নিয়ে পুলিশকে তথ্য সরবরাহ করে। তবে ‘সি’ ক্যাটাগরির সোর্সরা অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, মাদক উদ্ধারের ঘটনায় প্রথমেই সোর্সের দেওয়া তথ্যের ওপরে নির্ভর করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে সোর্স এক বা দুইবার তথ্য দিলেও এরপর আর তথ্য দিতে চায় না। পরে তাদের কাছ থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করতে টাকা খরচ করতে হয়। বেশিরভাগ সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা।
একাধিক থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সোর্স মেনটেইন করার নামে থানায় ‘ফাইল’ করার ব্যবস্থা রয়েছে। ফাইলের মাধ্যমে সংগৃহীত টাকার একটা অংশ রাখা হয় সোর্সদের জন্য।
পুলিশের সূত্র জানায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট অনেক উন্নত হয়েছে। অপহরণ, হত্যাকাণ্ড, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ এখন বিভিন্ন ডিজিটাল সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। যেকোনও তথ্য-উপাত্ত ও আসামির অবস্থান শনাক্তের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। এভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অপরাধী ও আসামিকে গ্রেফতার করার নজির এখন অনেক বেশি। ডিজিটাল সোর্স হিসেবে পুলিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, গুগল ম্যাপ, মোবাইল ফোন ডিভাইস, কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিয়ার) এর সহযোগিতা নিয়ে থাকে।
অপারেশন মানি কিংবা সোর্স মানির এই টাকা যাদের হাত ধরে সোর্সের কাছে যাওয়ার কথা, সেই কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্যরা তা পান না। মাঠ পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পুলিশের সোর্স মানি সরাসরি বরাদ্দ দেওয়া হয় পুলিশ সুপারের নামে। কিন্তু, অনেক পুলিশ সুপার নিজের ইচ্ছামতো সেটা খরচ করেন। অনেক সময় সামান্য কিছু টাকা খরচ করে বাকিটা নিজেই রেখে দেন।’
ডিএমপির পরিদর্শক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অতীতে থানার ওসিরা সোর্স মানি পেতেন না। তবে বর্তমানে পরিদর্শকদের দেওয়া হয়। এর মধ্যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সোর্স মানি হিসেবে প্রতিমাসে ২০-২২ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আর থানার পরিদর্শকদের (তদন্ত ও অপারেশন) প্রত্যেকে মাসে সাত হাজার টাকা করে পান। তবে থানার উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের কেউ সোর্স মানি পান না। তারা নিজেদের পকেটের টাকা ব্যয় করে সোর্সদের নিয়ন্ত্রণ করেন।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের একটি থানার একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রায় ছয় বছর ঢাকার বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করছি। কোনোদিন এ ধরনের বরাদ্দ পাইনি। কীভাবে আসে, কারা পান সেটাও জানি না।’
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘সোর্স মানি রাষ্ট্রের একটি বিনিয়োগ। এটি কোনও ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়, বরং অ্যাকশন স্পেসিফিক। কাজের ধরন ভেদে ভিন্ন ভিন্ন খরচ হয়।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন