গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত সেপ্টেম্বরে দেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বেরিয়ে আসা রাজনীতির আড়ালে অবৈধ ব্যবসার সীমাহীন কদর্য রূপ। সেই অভিযান এখনো চলছে।
কিন্তু এরমধ্যে পাঁচতারা হোটেলকেন্দ্রিক আরেক ব্যবসার খবর দেশের মানুষকে আবারো বিস্মিত করলো।
রাজনীতির আড়ালে যারা এই কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় জড়িত, তারা প্রধানত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের নেতা-কর্মী। খালেদ, সম্রাট, জিকে শামীম, পাপিয়া- এই নামগুলো এখন সবার মুখে মুখে। তারা কেউ যুবলীগ, কেউ যুব মহিলা লীগ আবার কেউবা স্বেচ্ছাসেবক লীগের।
কিন্তু অভিযানের সময় যত ঢাকঢোল পিটানো হয়, মামলায় তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়? তাছাড়া শেষ পর্যন্ত তারা কি শাস্তি পান? যারা জড়িত, তাদের সবাইকে কি আইনের আওতায় আনা হয়?
ক্যাসিনোকাণ্ডে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের সবার সঙ্গে একটি নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে, তিনি হলেন আওয়মী যুবলীগের তখনকার চেয়ারম্যান ওমর ফরুক চৌধুরী। তাকে যুবলীগ থেকে বিদায় করা হয়েছে। গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা হয়নি।
আর ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তখকার ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ক্যাসিনো থেকে আয়ের কোটি কোটি টাকা কোথায়? সম্রাটের নাকি এখন তেমন কোনো টাকা-পয়সার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্রাটের বিরুদ্ধে রমনা থানায় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য আইনে এবং তার সহযোগী আরমানের বিরুদ্ধে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় ও রমনায় মাদকদ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করেছে র্যাব।
জি কে শামীমের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তিনটি মামলা হয়েছে। আর খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও অর্থ পাচার আইনে তিনটি এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তদন্ত ও বিচার যেমন চলছে
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আটকদের কাছ থেকে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়েছে৷ জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, বিদেশি মদ ও অন্যান্য মাদক। খালেদ ও সম্রাটের অফিস থেকে জব্দ করা হয়েছে নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন।
দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ ৮ কোটি ৪৫ লাখ নগদ টাকাও জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ১৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩২টি চেক বই এবং ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। জব্দ করা হয়েছে প্রায় ৮ কেজি ওজনের অলঙ্কার, যার আনুমানিক মূল্য চার কোটি টাকা।
তবে দুই ভাই এনামুল ও রূপনের বাসা থেকে সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬শ’ টাকা উদ্ধারের ঘটনা ওই হিসাবের বাইরে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে একশ’রও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। সব মিলিয়ে মামলা হয়েছে ৩০টিরও বেশি।
তারমধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে পাঁচটি মামলায়। সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। খালেদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে অর্থ পাচার আইনের মামলায়। জিকে শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলায় বিচার চলছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও ক্যাসিনোকাণ্ডে মামলা করেছে ২২ জনের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধান চলছে। দুদক এ পর্যন্ত জিকে শামীমের ২৪৭ কোটি টাকা, খালেদের ৭৫ কোটি টাকা এবং লোকমানের ৩০০ কোটি টাকার সম্পদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছে৷ তবে সম্রাটের দেশে কোনো অর্থের খোঁজ এখনো তারা পায়নি।
পাপিয়া সমাচার
যুব মহিলালীগের নেতা শামিমা নূর পাপিয়া, তার স্বামী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমনসহ চারজনকে র্যাব গ্রেপ্তার করে ২২ ফেব্রুয়ারি। র্যাব জানায়, পাপিয়ার ইন্দিরা রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দু’টি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের দাবি, পাপিয়ার ঢাকায় দু’টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দু’টি ফ্ল্যাট, চারটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং গাড়ি ব্যবসায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ আছে বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি মামলায় র্যাবের দাবি করা সম্পদের উল্লেখ নেই। আর ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়ার আস্তানা এবং নারীদের জোর যৌন ব্যবসায় বাধ্য করার ব্যাপারেও কোনো তথ্য নেই। কিন্ত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বলেছিল, ‘‘পাপিয়া মাসে শুধুমাত্র হোটেল ওয়েস্টিনে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করেছেন। অথচ তার বছরে আয় দেখানো আছে ১৯ লাখ টাকা। ওয়েস্টিন হোটেলে প্রতিদিন শুধুমাত্র বারের খরচ বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতেন পাপিয়া। ওয়েস্টিনে তার নিয়ন্ত্রণে সাত জন নারী কাজ করতেন। তাদেরকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার করে মোট ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতেন পাপিয়া। হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেন্ট স্যুট পাপিয়ার নামে সবসময় ‘বুকড’ থাকতো। পাপিয়া জোর করে নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন।”
গল্পের সাথে মামলার ফারাক কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এক ধরনের চমক সৃষ্টি করতে চায়। চমক তৈরির একটা প্রবণতা থাকে। কিন্তু বিস্তারিত হোমওয়ার্ক থাকে না। সেটা মাদকবিরোধী অভিযান হোক আর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান হোক আর পাপিয়াবিরোধী অভিযান হোক। এর নেপথ্যে তো অনেকে থাকে, তাদের তো আর ধরা হয় না। ফলে চমক সৃষ্টি পর্যন্তই শেষ হয়।” আর এই চমকের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু আড়াল করা হয় বলেও মনে করেন তিনি।
রাজনীতিতে কেন ক্যাসিনো, ওয়েস্টিন
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, ‘‘রাজনীতি এখন অর্থকেন্দ্রিক হয়ে গেছে৷ ফলে যারা রাজনীতিতে আসেন, তারা মনে করেন, টাকা না হলে টিকে থাকা যাবে না। তাই তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেন টাকা আয়ের উপায় হিসেবে, সেটা বৈধ আর অবৈধ যেভাবেই হোক।” শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এর সঙ্গে রাজনীতির বড়রা যেমন জড়িত, তেমনি পুলিশ বা প্রশাসনের লোকও জড়িত। প্রকাশ হয় তখনই, যখন আর সামলানো যায় না।”
তার মতে, শুধু পাপিয়া, সম্রাট আর জিকে শামীমকে ধরলে তো হবে না। এরকম আরো অনেক পাপিয়া, সম্রাট আর জিকে শামীম আছে রাজনীতিতে। যদি প্রক্রিয়া বন্ধ না করা যায়, তাহলে আরো জন্ম নেবে।