আলোচিত

বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ংকর বাংলাদেশের বাস

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে বাস সম্পৃক্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে সড়কপথে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে সড়কপথে চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি ঘটে ২৮৭ জনের। এদিক থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে কেবল জিম্বাবুয়ে। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২১৭ জনের। এর বাইরে আর কোনো দেশে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানির নজির নেই। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোড সেফটি-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে দায় সবচেয়ে বেশি বাসের। পুলিশের তথ্য বলছে, দেশে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মোট প্রাণহানির মধ্যে বাসের সম্পৃক্ততা ছিল কমবেশি ২৬ শতাংশ। সড়কে প্রাণহানির সঙ্গে বাহনটির এ ব্যাপক সম্পৃক্ততার জন্য মূলত ফিটনেসের অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন দুর্ঘটনার তদন্তেও বিষয়টি উঠে এসেছে। একই কথা বলছেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরাও।

কয়েক বছর আগে ময়মনসিংহ অঞ্চলে একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। দুই বাসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণহানি ঘটে ১৬ জনের। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি দল ওই দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত চালায়। সরেজমিন পরিদর্শন ও বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তদন্তকারীরা দেখতে পান, এর মধ্যে একটি বাসের ফিটনেসের ঘাটতি ছিল। মৃত ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জনই ছিলেন ওই ফিটনেসবিহীন বাসের যাত্রী। এমনকি দুর্ঘটনায়ও মূল ভূমিকা রেখেছে ওই বাসের ফিটনেসের ঘাটতি।

ওই দুর্ঘটনার তদন্ত দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন বর্তমানে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, যে বাসটিতে বেশি হতাহত হয়েছিল, সেটি ছিল খুবই নড়বড়ে। সিটগুলো কোনো রকমে বসানো ছিল। বডি ছিল জরাজীর্ণ। যদি বাসটির ফিটনেস ঠিকঠাক থাকত, তাহলে ওই দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানি ঘটত না।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চলাচলরত বাসগুলোর সিংহভাগেরই বডি স্থানীয়ভাবে তৈরি। বিদেশ থেকে আনা হয় শুধু চেসিস। স্থানীয়ভাবে বডি বানানোর সময় এতে সিট বসানো হয় মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী। বেশি সিট বসানো হলে বাসের ভারসাম্য ঠিক থাকে না। আবার সিটগুলোর ওয়েল্ডিংও হয় নিম্নমানের। ফলে বাস যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন প্রাণহানি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।

এছাড়া চালকের অদক্ষতাকেও বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানি ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, সারা দেশে প্রায় দুই লাখ বাস-ট্রাক চালকের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব অদক্ষ চালকের হাতে বাস ছেড়ে দিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। সড়কে বাস দুর্ঘটনার পেছনে এসব অদক্ষ চালক অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ।

দূরপাল্লার রুটগুলোয় বাস দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব। বিশেষ করে দুই ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় যাত্রীচাপ বেড়ে গেলে দম ফেলার সুযোগ পান না চালকরা। এ কারণে প্রতি বছর সংঘটিত বাস দুর্ঘটনার বড় একটি অংশ ঘটে উৎসবের সময়গুলোতে। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণত দূরপাল্লার রুটে গাড়ি চালানোর সময় প্রতি ৫ ঘণ্টা পর চালককে বিশ্রাম দেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। একটানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত চালক যখন আর গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেন না, দুর্ঘটনা তখনই ঘটে।

এর বাইরে দুর্বল সড়ক অবকাঠামো, চালকদের ট্রাফিক আইন ভঙ্গের প্রবণতা, পথচারীদের অসচেতনতাসহ নানা কারণেও সড়কে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি গত বছর থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন সড়ক পরিবহন আইন। যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ এবং আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে দুর্ঘটনাসহ সড়ক খাতের নানা বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শিগগিরই এর সুফলগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

বিশ্বব্যাংকের ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলংকায় চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে যথাক্রমে ৮৭ ও ৮ জন ব্যক্তির।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাসের দায় ২৬ শতাংশ হলেও বিশ্বের অন্য কোনো দেশে তা ১৫ শতাংশের বেশি নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০১৮’ প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী বাস দুর্ঘটনাপ্রবণ অন্য দেশগুলোর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ায় এ হার ১৫ শতাংশ।

এছাড়া ঘানায় ১৩ শতাংশ, কাতারে ১২, বারবাডোজে ১১, মালিতে ১০, আইভরি কোস্টে ৮ ও কিউবায় ৭ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার কমবেশি ১ শতাংশ।

 

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button