এমপি আফজালের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কিশোরগঞ্জ-৫ (নিকলী-বাজিতপুর) আসনের সাংসদ মো. আফজাল হোসেন তার অপ্রাপ্তবয়স্ক তিন সন্তানকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত হকার’ হিসেবে দেখিয়ে রাজধানীর গুলিস্তানে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বিপণিবিতান ঢাকা ট্রেড সেন্টারে তিনটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ৩০ মার্চ ৩৯/১, ৩৫/২ ও ৩৫/১ নম্বর সিরিয়ালের ওই দোকানগুলো বরাদ্দ নেওয়ার সময় তার তিন সন্তান তুষার, হৃদি ও বৃষ্টির বয়স ছিল যথাক্রমে ১৪, ৮ ও ৬ বছর। বরাদ্দ নেওয়ার কিছুদিন পরই সাংসদ আফজাল প্রতিটি দোকান ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। এভাবে নামে-বেনামে ওই মার্কেটে বিপুলসংখ্যক দোকান বরাদ্দ নেওয়ার পর আফজাল তা চড়া দামে বিক্রি করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ রকম বেশ কিছু অভিযোগ পেয়ে তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত বৃহস্পতিবার তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে কমিশনের সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এমপি আফজাল হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানসংক্রান্ত কমিশনের আদেশের কপি আমরা ইতিমধ্যে হাতে পেয়েছি। কমিশনের আইন অনুযায়ী আফজাল ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়দেনা, আয়ের উৎস ও অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী চাওয়া হবে। পাশাপাশি দুদকের একজন কর্মকর্তাকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে।’
নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাংসদ আফজাল হোসেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘কমিশন অভিযোগ পেয়েছে, অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিয়েছে, এটা কমিশনের বিষয়। তবে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে সেটা প্রকাশ করা কতটুকু যৌক্তিক?’
আফজাল আরও বলেন, ‘শত কোটি বা হাজার কোটি কেন? আমার ২০ কোটি টাকার সম্পদও নাই। আমার সম্পদ যা আছে, তাতে এক টাকারও অবৈধ সম্পদ নাই।’
সাংসদ আফজালের বিরুদ্ধে দুদকে জমা হওয়া একটি অভিযাগে বলা হয়, আফজাল ও তার ছোট ভাই বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন (আশরাফ) বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে এখন এলাকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর, বালুমহাল দখলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যও না হয়ে ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি হয়ে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন আফজাল। তার এসব কাজে সহযোগী হয়ে ওঠেন ছোট ভাই আনোয়ার। গত বছরের ২১ আগস্ট আফজালের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ঘোড়াউত্রা নদীতে বালুমহাল দখলের সময় প্রতিপক্ষের তিন ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করা হয়। যাদের ওপর হামলা করা হয়েছে উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিপুল অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগে আরও বলা হয়, বাজিতপুর বাজারে নিজের নামে একটি পাঁচতলা শপিং মল তৈরি করেন আফজাল। ৫০ শতাংশ জায়গার ওপর তৈরি ওই শপিং মল সম্প্রসারণের জন্য এলাকার পাঁচজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে তাদের ব্যবসায়িক স্থাপনা থেকে উচ্ছেদ করেন। এ ছাড়া মার্কেটটির সামনের অংশে থাকা খাল ভরাট করেন। বাজিতপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য নির্ধারিত খাসজমির প্লটটিও দখল করে রেখেছেন আফজাল। বাজিতপুরে নিজের গ্রাম শশের দিঘি নোয়াপাড়া দিলালপুরে তিনতলা ভবন এবং বাজিতপুর পৌর এলাকার ডাকবাংলোর সামনে ২৭৫ শতাংশ জমি রয়েছে আফজালের। এ ছাড়া আফজাল দেশ থেকে অর্থ পাচার করে সিঙ্গাপুরে ফ্ল্যাট ক্রয় এবং অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনেছেন।
ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গেও আফজালের সংশ্লিষ্টতা ছিল উল্লেখ করে দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এবং আরেক যুবলীগ নেতা নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের সহযোগী ছিলেন সাংসদ আফজাল। তিনি সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ক্যাসিনোর তালিকাভুক্ত ‘জুয়াড়ি’। রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধা ক্রীড়াচক্রসহ বিভিন্ন ক্লাবে তার অংশীদারত্ব ছিল। তার রয়েছে চারটি পাসপোর্ট। নামে-বেনামে আফজালের বিপুল সম্পদের মধ্যে রয়েছে আফজাল সুজ লিমিটেডের মালিকানা, ৬/৪ সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন কটেজে বি-৪ ও বি-৫ নম্বরের দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫ আগামসি লেনে পাঁচতলা বাড়ি, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেড কার্যালয়ের পেছনে লাকী বিল্ডার্সের তৈরি ভবনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলা দুটি বাড়ি। এ ছাড়া রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর প্রধান সড়কসংলগ্ন একটি সাততলা বাড়ি, উত্তরায় হুইপ আতিউর রহমান আতিকের সঙ্গে যৌথভাবে সাত কাঠার প্লট এবং কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি কারখানার মালিক তিনি।
২০১৪ সালের ২৪ জুলাই সাংসদ আফজালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের কাপড় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন রিপনের করা মামলায় আফজালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে ওই পরোয়ানা জারি করা হয়। মামলার বাদী তার আর্জিতে বলেন, এমপি আফজাল তার তিন সন্তানকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত হকার’ দেখিয়ে ঢাকা ট্রেড সেন্টারের তিনটি দোকান বরাদ্দ নেন। রিপন প্রতিবাদ করলে এমপি আফজাল তাকে ভয়ভীতি দেখান। বরাদ্দ নেওয়ার কিছুদিন পরই তিনি প্রতিটি দোকান ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে প্রায় আড়াই শ দোকান বরাদ্দ নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন আফজাল। তিনি ঢাকা ট্রেড সেন্টার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ এক দশক ধরে দখল করে আছেন। মার্কেটটির বেজমেন্ট, গাড়ি পার্কিং এবং এক্সেলেটরের সিঁড়ির জায়গাসহ যেখানে ফাঁকা পেয়েছেন, সেখানেই অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করেছেন।
সূত্র: দেশ রূপান্তর