আলোচিত

একের পর এক হত্যা: রাজপথে বিছানো ভয়ঙ্কর জাল

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নূর ইসলাম, বয়স ৪০ বছর। পেশায় অটোরিকশাচালক। খেটে খাওয়া মানুষের চেনা ছাপ মুখে। তবে এসব হচ্ছে নূর ইসলামের মুখোশ। সেই মুখোশের আড়ালে প্রকৃত মানুষটি মোটেও নিরীহ নয়; ভয়ঙ্কর এক খুনি- সিরিয়াল খুনি। পেশা তার ছিনতাই। আর এ কর্ম সম্পাদনকালে যে ব্যক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে নূর ইসলাম ও তার চক্রের সদস্যরা, ঠাণ্ডা মাথায়। এভাবে একের পর এক হত্যাকা- ঘটিয়েছে তারা। রাতের রাজধানীর রাজপথে নিরীহ যাত্রীদের জন্য তারা বিছিয়ে রাখে ভয়ঙ্কর এক জাল।

অটোরিকশাচালকের বেশে নূর ইসলাম তার যানে যাত্রী তুলে সেই যাত্রীর টাকা-পয়সা ও মূল্যবান মালামাল লুটে নেয়। বাধা দিলে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। এভাবে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। গত ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে কারওয়ানবাজার রেলক্রসিংয়ের ওপরের ফ্লাইওভার থেকে এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের পর তদন্তে নামে পুলিশ। শিক্ষার্থীর ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হয় নূর ইসলামসহ তিন ছিনতাইকারী। তাদের জবানিতেই বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর এসব তথ্য। নূর ইসলাম ছিনতাই ও হত্যাকা-ের যে বর্ণনা পুলিশের কাছে দিয়েছে, তা গল্প-সিনেমাকেও হার মানায়।

নূর ইসলামের জবানিতে বেরিয়ে এসেছে, তাদের বসবাস রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকায়। রাত গভীর হলে তারা অটোরিকশা নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। চালকের পাশাপাশি অটোরিকশায় যাত্রীবেশে থাকে দুই সদস্য। তারা নিরীহ যাত্রীদের কৌশলে অটোরিকশায় তুলে সব কেড়ে নেয়। কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করলে নির্দ্বিধায় হত্যা করা হয়। চক্রটি কতজনকে হত্যা করেছে এর সঠিক হিসাব নেই। তবে নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত, এক মাসেরও কম সময়ে অন্তত চারজনকে হত্যা করে ঢাকার দুটি ফ্লাইওভারে লাশ ফেলে পালিয়ে যায় এ চক্রের সদস্যরা।

নূর ইসলাম বলেছে, এই চারজন ছাড়াও গত চার মাসে আরও অন্তত পাঁচটি হত্যার সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত। এই সময়ে আরও অন্তত ১০ জনকে অজ্ঞান অবস্থায় বিভিন্ন সড়কে ফেলে যায় তারা। পরে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তার জানা নেই। এমনও অনেক ঘটনা ঘটেছে, শ্বাসরোধ করে সড়কে ফেলার পর লাশের ওপর দিয়ে ট্রাক বা বাসও চলে গেছে। সেটি পরে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবেই পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।

একের পর এক খুন করলেও এ চক্রের বিষয়ে এতদিন অন্ধকারে ছিল পুলিশ। নূর ইসলামের জবানিতে এসব কাণ্ড শুনে থ’ বনে গেছেন পুলিশ কর্মকর্তারাও। চক্রটি চার বছরে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার ছিনতাই করেছে। নূর ইসলাম বলছে, গত চার মাসে সে নিজেই অন্তত ৬০০ ছিনতাইকাণ্ডে জড়িত।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গত ৫ জানুয়ারি হাতিরঝিলের কারওয়ানবাজারসংলগ্ন ফ্লাইওভার থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও বনানীর একটি হোটেলের কর্মী মিজানুর রহমানের লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর পার্শ্ববর্তী একটি এলাকা থেকে নূর ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে শুক্রবার ওই মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় নূর ইসলাম। সে ছাড়াও এতে আরও দুজন সরাসরি জড়িত, যাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এদিকে মিজান হত্যা মামলায় গত শনিবার আবদুল্লাহ বাবু ও জালাল নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা দুজনও গতকাল এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার অভিযানের নেতৃত্ব দেন তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জানান, এ ছিনতাই চক্রের দলনেতাসহ ৯ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার তিনজন ছাড়াও অন্যদের ধরার চেষ্টা চলছে।

চার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কুড়িল ফ্লাইওভার এবং হাতিরঝিল ফ্লাইওভারে চার লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তবে এসব হত্যার কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি এতদিন।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মিজান হত্যার বিষয়ে খুনি নূর ইসলাম জবানবন্দিতে জানায়, ৫ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে বনানীর কাকলীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিজান। এ সময় নূর ইসলাম মিজানের কাছে গিয়ে তার গন্তব্য জানতে চান। কুড়িল বিশ্বরোড বললে নূর ইসলাম তাকে জানান, তারাও ওই দিকে যাচ্ছেন। মিজান চাইলে অটোরিকশায় উঠতে পারেন। ওই অটোরিকশার পেছনে নূর ইসলামের দুই সহযোগীও ছিল। মিজান অটোরিকশায় উঠলে, আগে থেকেই যাত্রীবেশে থাকা দ্ইু ছিনতাইকারীর একজন মিজানের ঘাড়ে পিস্তলের মতো করে আঙুল শক্ত করে ধরে। এ সময় অন্যজন মিজানের দুই হাত চেপে ধরে বলেÑ ‘আমরা খারাপ লোক, যা আছে দিয়ে দে।’ তখন মিজান পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করতে চাইলে, এক ছিনতাইকারী মিজানের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে। একসময় মিজান নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মিজানের সঙ্গে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও ৩০০ টাকা নিয়ে নেয় তারা। তার পর চক্রের সদস্যরা রামপুরা, মৌচাক ও মগবাজার হয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। কারওয়ানবাজারের রেলক্রসিং বরাবর নির্জন দেখে সেখানেই মিজানের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত নূর ইসলাম বলেছে, ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে কুড়িল ফ্লাইওভারের ভাটারা থানা অংশ থেকে জুয়েলারি ব্যবসায়ী আক্তার হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গলায় গামছা পেঁচানো ছিল। ৩১ ডিসেম্বর রাতে ৩০০ ফিটের কুড়িল ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় একটি লাশ উদ্ধার হয়। তাকে আবদুল্লাপুর থেকে অটোরিকশায় তোলে চক্রের সদস্যরা। তার পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ৪ জানুয়ারি মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার পর কুড়িল ফ্লাইওভারের খিলক্ষেত অংশে লাশ ফেলে যায় তারা।

অস্ত্র তাদের গামছা : নূর ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দেখতে নিরীহ এই চক্রের সদস্যরা সব সময় লুঙ্গি পরে থাকে। গলায় থাকে গামছা। তাদের সঙ্গে সব সময় একটি বস্তা থাকে। এর কারণ হলো- পুলিশের চেকপোস্টের মধ্যে পড়লে তারা বস্তা দেখিয়ে বলে, কারওয়ানবাজারে সবজি কিনতে যাচ্ছে। ছিনতাইয়ের মিশনে থাকে তিন সদস্য। এর মধ্যে একজন চালক, অন্য দুজন যাত্রীবেশে পেছনে থাকে। রাত ৯টার পর তারা ঢাকায় প্রবেশ করে। তারা রাত আড়াইটা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত অধিকাংশ ছিনতাই করে। বিভিন্ন স্পটে তারা অটোরিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের গন্তব্য জিজ্ঞাসা করে। গন্তব্যের কথা জানালে অটোরিকশাচালক জানান, তারা ওই গন্তব্যেই যাবেন। তখন যাত্রীকে অটোরিকশায় ওঠার অনুরোধ করে। তখন পেছনে যাত্রীবেশে থাকা একজন অটোরিকশা থেকে নেমে যান। যাত্রীকে তারা কৌশলে চক্রের দুই সদস্যের মাঝে বসতে দেন।

কিছুদূর যাওয়ার পর এক সদস্য হাতের আঙুল শক্ত করে যাত্রীর ঘাড়ে ধরে বলে- ‘পিস্তল ধরেছি, সব দিয়ে দে, না দিলে গুলি করে দেব।’ এ সময় অন্যজন যাত্রীর দুই হাত চেপে ধরে। যাত্রী চিৎকার বা জোর করলে তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে দুজনে চেপে ধরে। এ সময় অনেক যাত্রী শ্বাসরোধ হয়ে মারা যান। অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যান। পরে এসব যাত্রীকে নির্জন স্থানে ফেলে পালিয়ে যায় তারা। ফ্লাইওভারে সড়কবাতি না থাকায় এবং পুলিশের টহল না থাকায় অধিকাংশ সময় যাত্রীকে খুন করে সেখানে ফেলে রাখা হয়। এই চক্রটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে ছিনতাই করে থাকে।

 

সূত্র: আমাদের সময়

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button