নদীর প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দখল ও দূষণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে সারা দেশের বিভিন্ন শহরের পাশ দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো। এককালে এসব ‘শহুরে নদীতে’ প্রাণবৈচিত্র্য থাকলেও এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমন ৪৮টি নদীর প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ লক্ষ্যে ২০১৮ শেষের দিকে ‘৪৮ নদী রক্ষা, নদীর তথ্য ভাণ্ডার তৈরি ও গবেষণা প্রকল্প’ নামে চার বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়।এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম এক বছরের ১৫টি নদীর জরিপ করা হয়েছে।
‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও ৪৮ নদী রক্ষা প্রকল্প’-সূত্র বলছে, কোনও কোনও নদীতে প্রাণের অস্তিত্বই মিলছে না। নদীর পানির ভয়াবহ বিষাক্ত পরিবেশে কোনও উদ্ভিদ ও প্রাণি আর জন্মাতে পারছে না।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সব নদ-নদীর হাইড্রো মরফোলোজিক্যাল ও থিমেটিক মানচিত্র তৈরি হবে, নদীর নাব্যতা, গতিপথ, মাছ ও জলজ প্রাণির আবাসস্থল চিহ্নিত হবে, জনসচেতনতা বাড়বে, নদী নিয়ে অনিয়ম কমবে। নদী রক্ষায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সক্ষমতা বাড়বে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ইকরামুল হক বলেন, ‘মূলত শহরের আশেপাশের নদীগুলোতে দখল-দূষণের পরিমাণ বেশি হয়। তাই এই ৪৮ নদীকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমরা প্রথম এক বছরে ১৫টি নদী ও এর আশেপাশের কয়েকটি শাখা নদীসহ মোট ২৪টি নদীর জরিপ কাজ করেছি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে বালু ও তুরাগ নদী।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বালু নদীতে জীববৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, সেখানে কোনও জলজ উদ্ভিদ জন্মাতেই পারছে না। এ নদীকে বাঁচাতে আমরা যে জরিপ করেছি, তাতে মনে হয়েছে, নদীর দুই পাশে যে অবৈধ দখল আছে, সেগুলো তা আগে মুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নদীর তীরবর্তী শিল্প কারখানার কোনও কেমিক্যাল নদীতে ফেলা যাবে না বলে আমরা সুপারিশ করেছি। একই ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে তুরাগের ক্ষেত্রেও।’
যেসব নদীতে জরিপ চলছে
জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ, বালু নদী ও এই দুই নদীর শাখা নদী চিলাই, সুতি ও পারুলি নদী।
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা।
টাঙ্গাঈল, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী।
ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশাল জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ, কুমার নদী, কুমার নদীর নিচের দিকের প্রবাহিত অংশ লোয়ার কুমার ও আপার কুমার নদী।
ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, বাগেরহাট, পিরোজপুর, মাগুরা, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি ও বিলরুট চ্যানেল এবং এর শাখা নদী বর্ণিবাওড়, টাঙ্গাইল জেলার পুংলী নদী।
কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মাগুরা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গড়াই। খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, ফেনী ও কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত চেঙ্গি ও ফেনী নদী।
যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ , মাগুরা, মেহেরপুর ও নড়াইলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চিত্রা।
রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বড়াল নদী এবং তার শাখা নদী তুলশী, নারদ ও মীর্জা মাহমুদ নদী ও কুমার নদ।
এদিকে টাঙ্গাইল জেলার লৌহজং নদী ও জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বংশী নদীর জরিপ কাজ এখন চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরও কিছু নদীর জরিপ করা হয়ে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
এরমধ্যে আছে নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সোমেশ্বরী; খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, রাঙমাটি, ফেনী ও কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতি, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর ও নড়াইলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা ও ভৈরব; জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত পুরনো ব্রহ্মপুত্র; মৌলভীবাজারের মনু; বরিশাল ও পিরোজপুরের সন্ধ্যা এবং বরিশাল, পিরোজপুর ও বাগেরহাটের বলেশ্বর ও কচা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ
জরিপ দল যে তথ্য তুলে এনেছে, তাতে দেখা গেছে, নদী ড্রেজিং করে সেই বালু ও মাটি আবার নদীর কাছাকাছি জায়গায় ফেলা হচ্ছে। এতে বৃষ্টির সময় এই মাটি ও বালুন গড়িয়ে আবার নদীর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে নিরাপদ দূরত্বে মাটি ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
নদীর সঙ্গে যুক্ত খালগুলোকে খনন করে প্রশস্থ ও গভীর করার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কমিশনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে যৌথ জরিপের মাধ্যমে নদীর তীরভূমি ও প্লাবনভুমি চিহ্নিত করার কাজ করা হয়েছে। এছাড়া, নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণও জরুরি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে, ইকো ট্যুরিজম ও সৌন্দর্য বাড়নোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে জরিপ দল।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘আমরাই নদীগুলোকে দিনের পর দিন ধ্বংস করেছি। এখন দেরিতে হলেও আমাদের এসব নদী বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এসব নদীর বাস্তব অবস্থা কী, তা না জেনে কোনও উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা এজন্য জরিপ করছি। এর ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ নদী বাঁচানোর জন্য কী কী করতে হবে, তা এই জরিপের সুপারিশে উঠে আসবে বলে মনে করেন তিনি।