আমবয়ানে বিশ্ব ইজতেমা শুরু, মুসল্লির ঢল: তিন মুসল্লির মৃত্যু
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : টঙ্গীর তুরাগতীরে যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সড়ক-মহাসড়কে হাঁটছেন মুসল্লিরা। কারও মাথায়, কারও কাঁধে আবার কারও হাতে একাধিক ব্যাগ। সকালের কনকনে শীতে উপেক্ষা করে ছুটছেন তুরাগতীরের ইজতেমা ময়দানের দিকে। মানুষের এই ঢল তাবলিগের সবচেয়ে বড় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে।
শুক্রবার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এই পর্বে অংশ নিয়েছেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।
ভোরে ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা খোরশেদ আলমের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এই পর্বের ইজতেমা। বেলা দেড়টায় জুমার নামাজ পড়াবেন মাওলানা জুবায়ের। ইজতেমায় যোগ দিতে এসে এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। ইজতেমাকে ঘিরে দুই দিন আগে থেকেই মুসল্লিরা আসতে থাকেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসল্লি আসেন বৃহস্পতিবার।
ময়দানে অবস্থান করা মুসল্লিরা নিজ নিজ খিত্তায় বসে শুনছেন আমবয়ান। জামালপুর থেকে আসা ৪৯ নম্বর খিত্তার কয়েকজন সাথি জানান, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁরা প্রতিবছর তুরাগতীরের এই ইজতেমায় আসেন। এবারও তাঁরা একটু আগেভাগেই চলে এসেছেন। রফিক নামের এক সাথি বলেন, এবার প্রচুর মুসল্লি। আগে না এলে জায়গা পাওয়া যেত না।
প্রথম পর্বের ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী জহির ইবনে মুসলিম বলেন, মুসল্লিরা বেশি থাকার কারণে বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই বয়ান শুরু হয়। তিনি বলেন, আগামী রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হবে।
তিন মুসল্লির মৃত্যু
এবারের ইজতেমায় এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনে ও রাতে দুজন মুসল্লি ও আজ একজন মুসল্লির মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন মো. ইয়াকুব শিকদার (৭৫), মোহাম্মদ আলী (৭০), মোহাম্মদ খোকা মিয়া (৬০)। এর মধ্যে ইয়াকুব আলীর বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়, মোহাম্মদ আলীর চট্টগ্রাম ও খোকা মিয়ার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তিনজনই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন।
মুসল্লিদের নিরাপত্তাব্যবস্থা
ইজতেমাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাত স্তরে কাজ করবেন পুলিশের প্রায় ৮ হাজার সদস্য। পুরো ইজতেমার মাঠ ঘিরে থাকবেন র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা। পুলিশের নিজস্ব ১৬টি ওয়াচ টাওয়ারসহ র্যাবের নিজস্ব ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো ইজতেমা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ ছাড়াও ইজতেমা মাঠের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা। থাকবে পুলিশের হোন্ডা টিমসহ সাদাপোশাকের পুলিশ। তুরাগ নদেরও কয়েক জায়গায় অবস্থান করবেন পুলিশের সদস্যরা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেহেতু দুটি পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, সেহেতু আমরা আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন পর্যন্ত সার্বিক অবস্থা ভালো। আশা করছি বাকি ইজতেমাটুকুও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে।’
ইজতেমা ঘিরে প্রস্তুতি
গাজীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এবার পুরো ইজতেমায় কাজ করবে জেলা প্রশাসনের ৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য ৩১টি ভবনে রয়েছে ৮ হাজার ৩৩১টি শৌচাগার। ১৭টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা হবে মুসল্লিদের। তিনটি গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ৪টি শক্তিশালী জেনারেটর প্রস্তুত থাকবে। মুসল্লিদের পারাপারের জন্য ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর ৭টি ভাসমান সেতু প্রস্তুত করা হয়েছে। মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১০টি বিশেষ ট্রেন চালু করা হবে এবং সব ট্রেনের টঙ্গী রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি দেওয়ার কথা রয়েছে। আর এবার পুরো ইজতেমাকে ৯১টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ জেলার লোকজন খিত্তা অনুসারে বসবেন।
জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করছি। আশা করছি, মুসল্লিদের কোনো কিছুতেই সমস্যা হবে না।’
খিত্তাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থান
আগত মুসল্লিরা যে সব খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হলো—গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২,৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫-১৯ ও ২৪, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯,৩২), রাজশাহী (খিত্তা-২০), নওগাঁ (খিত্তা-২১), নাটোর (খিত্তা-২২), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২৩), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৬), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩০)। নড়াইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩৩), নীলফামারী (খিত্তা-৩৪), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৩৫), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৬), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৭), মুন্সিগঞ্জ (খিত্তা-৩৮), মাগুরা (খিত্তা-৩৯), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৪০), বগুড়া (খিত্তা-৪১), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪২), ফরিদপুর (খিত্তা-৪৩), যশোর (খিত্তা-৪৪), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৫), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৬), নরসিংদী (খিত্তা-৪৭), ভোলা (খিত্তা-৪৮), জামালপুর (খিত্তা-৪৯), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৫০,৫১), মেহেরপুর (খিত্তা-৫২), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৫৩), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৪), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৫), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৬), বরিশাল (খিত্তা-৫৭), রাজবাড়ি (খিত্তা-৫৮), শেরপুর (খিত্তা-৫৯), শরীয়তপুর (খিত্তা-৬০)। মাদারীপুর (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), কক্সবাজার (খিত্তা-৬৩), রাঙমাটি (খিত্তা-৬৪), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৬৫), বান্দরবান (খিত্তা-৬৬), ফেনী (খিত্তা-৬৭), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৮), লক্ষ্মীপুর (খিত্তা-৬৯), চাঁদপুর (খিত্তা-৭০), বি. বাড়িয়া (খিত্তা-৭১), খুলনা (খিত্তা-৭২), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭৩), বরগুনা (খিত্তা-৭৪), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৫), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৬), পিরোজপুর (খিত্তা-৭৭), ঝালকাঠি (খিত্তা-৭৮), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৭৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৮০), মৌলভীবাজার (খিত্তা-৮১), পাবনা (খিত্তা-৮২), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৩), পঞ্চগড় (খিত্তা-৮৪), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৫), জয়পুরহাট (খিত্তা-৮৬), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৮৭)।
তা ছাড়া রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পাবনা, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরের খিত্তাগুলোর অবস্থান তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে। অন্যদিকে ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯১ ও ১৫ (খ) নম্বর খিত্তাগুলো সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো