আলোচিত

যে কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বেড়েছে প্রাণহানি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত এক বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দেশটির সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশিদের প্রাণহানির সংখ্যা তিন গুন বেড়েছে।

মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

এতে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী- বিএসএফ’র হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৮ জন বাংলাদেশি। এরমধ্যে ৩৩ জন গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে এবং বাকি ৫ জনকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে।

এবছর বিএসএফ’র হাতে আহত হয়েছে ৩৯ জন এবং আটক হয়েছে আরো ৩৪ জন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক।

কিন্তু এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে সীমান্তে এমন প্রাণহানির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন। সে হিসেবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রাণহানির সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।

এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, “সীমান্তে হত্যার বিষয়টি এক বছরে প্রচুর বেড়েছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীরা সীমান্ত পার করছেন এমন কাউকে দেখলেই গুলি করে ফেলছে। এটা বদলাতে হবে।”

তিনি বলেন, দুই দেশের সীমান্তে অভিন্ন পাড়া রয়েছে। যেখানকার মানুষেরা একে পাড়া হিসেবেই দেখে এবং ভারতের বাসিন্দারা বাংলাদেশে আসে আবার বাংলাদেশিরা ভারতে যায়। আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করা ছাড়াও জীবিকার সন্ধানেও মানুষ সীমান্ত পারাপার হয়ে থাকে।

“দু’ দেশেরই আইন অনুযায়ী, এসব মানুষদের গ্রেফতার ও বিচার করার কথা। দু’দেশের সরকারি বাহিনীই যদি এটি মেনে চলেন তাহলে দেখা মাত্রই গুলি করার কথা না। কিন্তু সেটা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

এ ধরণের ঘটনাকে মারাত্মক ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে এসব বাংলাদেশিদের অবৈধ ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

শিপা হাফিজ আশঙ্কা করে বলেন যে, ভারতে নতুন যে নাগরিকত্ব আইন করা হয়েছে এর কারণে আরো বেশি মানুষ সীমান্ত পার করতে পারে।

সীমান্ত হত্যা ঠেকাতে এ বিষয়টিও মাথায় রেখে সামনের বছরে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বিএসএফ-এর গুলিতে ফেলানী খাতুনের হত্যার পর বাংলাদেশের দাবির মুখে ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকের পর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে একটি সমঝোতা হয়েছিল।

কিন্তু সেটিও ফিকে হয়ে আসছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

তারা বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত, সীমান্ত চৌকিতে টহল বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত বৈঠক এবং সেসময় নতুন সিদ্ধান্ত মেনে চলার প্রবণতা থাকার কারণে মাঝে একটা সময় সীমান্তে হত্যা কমে এসেছিল।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ এসব ভুলে যায় বলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আবার বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর চেয়ারম্যান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, আমরা ভারতীয়দের গুলি করি না, কিন্তু তারা(বিএসএফ) বাংলাদেশিদের মারে।

তিনি বলেন, বিএসএফ-এ যারা কাজ করে তারা সাধারণত নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করে। যার কারণে তারা মানসিকভাবে সুখী থাকে না। এ কারণেই তারা ট্রিগার হ্যাপি হয়ে যায়। মানসিকভাবে চাপের মুখে থাকে বলেই এ অবস্থা হয় বলে অনেকে মনে করেন। এটা একটা কারণ।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, বিএসএফ’র এসব সদস্যরা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে অর্থাৎ যারা অধিকর্তা তারাও এদের দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। যার কারণে সীমান্ত হত্যা বেশি ঘটে।

যারা বিএসএফ’র হাতে যারা প্রাণ হারাচ্ছে তাদেরকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এদের বেশিরভাগই সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে গরু বা অন্যান্য ব্যবসা সামগ্রী নিয়ে আসতো।

মিস্টার আহমেদ বলেন, “অনেকে বলে যে এখানে ভাগাভাগির একটা বিষয় থাকে। যদি তাদের খুশি করা যায় তাহলে তারা গোলাগুলি করে না। এর ব্যতিক্রম হলে তখন হয়তো দেখলে গুলি করে এবং লোকজন মারা যায়।”

তবে সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুদেশের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার পর এই হার কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলেও জানান তিনি।

হত্যা বন্ধে কি করতে হবে?
মিস্টার আহমদ বলেন, সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশিদের হত্যা থামাতে হলে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও নিয়ন্ত্রণ দরকার।

তাঁর মতে, সীমান্তে হত্যা বিশেষ করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতের সাথে এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে যে এ ধরণের হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

“এ বিষয়টি বিরতি দিয়ে নয় বরং মাঝে মাঝেই আমাদের বন্ধুদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে, সীমান্ত হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন তিনি।

বিশ্বের প্রায় সব খানেই অভিন্ন সীমান্তের দেশগুলোতে মানুষ আসা-যাওয়া করে। কিন্তু তাই বলে তাদের মেরে ফেলাটা সমাধান নয় বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশের দিক থেকে গুলির ঘটনা তেমন একটা ঘটে না বললেই চলে। তবে এ বছর এ ধরণের দু-একটা ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।

তিনি বলেন, এক সময় অধৈর্য হয়ে দু’পক্ষই যদি গোলাগুলি শুরু করে তাহলে এ ধরণের ঘটনা আরো বাড়বে।

এর পরিবর্তে দু’পক্ষকেই ধৈর্য ধরতে হবে এবং যেসব মানুষ এভাবে সীমান্ত পারাপার করে থাকে তাদেরকে গ্রেফতার এবং এর পরবর্তীতে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় আলোচনার মাধ্যমেই দুদেশকে ঠিক করতে হবে। এ বিষয়ে দুদেশের সম্মতিতে কিছু প্রোটোকল থাকতে হবে বলেও মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

“এ ধরণের কোন সুচিন্তিত সিদ্ধান্তও এখনো দুদেশের মধ্যে নেই,” বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ।

তবে সীমান্ত হত্যার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিক ভাবে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

সূত্র: বিবিসি

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button