গাজীপুরের সুখ-দুঃখ-৪: ভোগান্তির শেষ নেই জয়দেবপুর রেল জংশনে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রতিদিন গাজীপুর শহর থেকে আন্তনগর ট্রেন ভ্রমণে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন ৫০ হাজার যাত্রী। গাজীপুরের জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে বাসিন্দাদের প্রধান আটটি আন্তনগর ট্রেন ভ্রমণে যেতে হয় ঢাকায়। লোকাল যাত্রীদের ট্রেনে চড়তে হয় গাজীপুর শহর থেকে। এমন নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জয়দেবপুর রেল জংশন।
এখানে যাত্রীদের জন্য নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি না থাকায় এখানকার যাত্রীদের ঢাকার উত্তরার বিমানবন্দর রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়। কিছু অসাধু কর্মকর্তা অতিরিক্ত টাকায় টিকিট বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জংশনের দ্বিতীয় কিংবা মধ্যবর্তী লাইনটিতে প্লাটফর্ম সুবিধা না থাকায় ট্রেনে যাত্রীদের ঝুঁকি নিয়ে ওঠানামা করতে হয়। এ ছাড়া আন্তনগর ট্রেনগুলোতে এই জংশন দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। এই জংশনের যাত্রীদের জন্য আসন বরাদ্দ আছে মাত্র ৫৪৩টি। অথচ জংশনটিতে আটটি আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই। এসব ট্রেন হচ্ছে তিস্তা, মোহনগঞ্জ, অগ্নিবীণা, বনলতা, ব্রহ্মপুত্র, রংপুর, পঞ্চগড় ও বেনাপোল এক্সপ্রেস।
এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে এ আটটি ট্রেনের যাত্রাবিরতির জন্য জোরালো দাবি জানানো হলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না। এতে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রীকে। আন্তনগর তিস্তা ট্রেনটিতে জয়দেবপুর জংশনে যাত্রীদের জন্য প্রথম শ্রেণি ও এসিতে একটি আসনও বরাদ্দ নেই। কিন্তু পাশের ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মতো ছোট একটি স্টেশনের জন্য এসিতে আসনসংখ্যা বরাদ্দ ১৬টি এবং প্রথম শ্রেণিতে পাঁচটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ বছর আগেও এ স্টেশনটি তৃতীয় শ্রেণির স্টেশন ছিল। বর্তমানে এ স্টেশনটি প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ১৬ বছর আগে এ স্টেশনকে জংশনে উন্নীত করা হয়। ১৩টি প্রথম শ্রেণির রেলস্টেশনের মধ্যে এ স্টেশনের রাজস্ব আয় তৃতীয় পর্যায়ে। কিন্তু জনবলের দিক থেকে যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা এখনো তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে এ জেলা শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এ জংশন দিয়ে আন্তনগর ট্রেনসহ দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ৭২টি ট্রেন চলাচল করে। এগুলোতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। জয়দেবপুর রেল জংশনের প্লাটফর্মে ১০টি চেয়ার আসন থাকলেও শ্রেণি অনুযায়ী যাত্রী বিশ্রামাগার না থাকায় মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধাসহ শত শত যাত্রীকে ট্রেনের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এখানে নেই কোনো বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের ব্যবস্থা। প্লাটফর্মে নেই ইলেকট্রনিক টাইমিং মনিটর। প্লাটফর্মসহ স্টেশন এলাকায় সব সময়ই থাকে নোংরা পরিবেশ।
রেল জংশনটিতে বর্তমানে ক্ষুদ্র্র পরিসরে একটি কক্ষ থেকে দুটি মাত্র কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করা হয়। এর ফলে টিকিট কিনতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। কাউন্টারের সামনে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় টিকিট কাটতেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এ সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে টিকিট বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া আন্তনগর বুকিং কাউন্টারের সামনেই রয়েছে টিনের বাক্সের একটি বেসরকারি মেইল ট্রেনের টিকিট কাউন্টার।
সরেজমিন দেখা যায়, স্টেশনে ট্রেন থামার পর যাত্রীদের ওঠানামায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। এ সময় কয়েকজন যাত্রী ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ স্টেশনটি জংশনে উন্নীত হওয়ার পর শুধু একটি প্লাটফর্ম নির্মাণ ছাড়া অবকাঠামোগত আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে যে দুটি প্লাটফর্ম রয়েছে, সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় ছোট। এ ছাড়া যাত্রীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনদুর্ভোগ লাঘবে আন্তনগর ট্রেনগুলো থামার উদ্যোগ নিতে জেলা প্রশাসক গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রেলওয়ের পরিসংখ্যানে রাজস্ব আয়ের দিক দিয়ে জয়দেবপুর রেল জংশনের স্থান পঞ্চম। কিন্তু আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রীসেবার মান নেই বললেই চলে।
জয়দেবপুর জংশন দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন চাকরিজীবী মতিন সরকার। তিনি জানান, এখানে যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য কোনো টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। এ জন্য যাত্রীদের অসুবিধা হয়।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমি আক্তার জানান, দুই নম্বর লাইন দিয়ে যখন ট্রেন আসে, প্লাটফর্ম না থাকায় তখন তাদের অনেক ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে ওঠানামা করতে হয়।
অপর এক যাত্রী আইনজীবী মনোয়ার হোসেন জানান, যাত্রীদের পর্যাপ্ত আসন না থাকায় অনেক সময় ট্রেন বিলম্বে আসায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
জয়দেবপুর জংশনের নিরাপত্তা বাহিনীর উপ-পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘১৩ জন নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। কমপক্ষে ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী দরকার। ছাদে যাত্রীদের উঠতে নিষেধ করলেও ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু যাত্রী দ্রুত উঠে পড়েন।’
জানতে চাইলে জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. শাহজাহান বলেন, জয়দেবপুর জংশনের নানা ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র দেওয়া হয়েছে। এ জংশন দিয়ে প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন চলাচল করে। দেশের ১৭টি রেল জংশনের মধ্যে জয়দেবপুর রেল জংশন দিয়ে যাত্রী যাতায়াত করে সবচেয়ে বেশি। রাজস্ব আয়ের দিক দিয়েও এটি প্রথম। বর্তমানে এ জংশন থেকে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আয় হচ্ছে। আন্তনগর ট্রেনগুলো থামলে এবং আসনসংখ্যা বাড়ানো হলে যাত্রীসেবার পাশাপাশি স্টেশনের রাজস্ব আয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
আরো জানতে…..
গাজীপুরের সুখ-দুঃখ-৩: ময়লার শহর গাজীপুর
গাজীপুরের সুখ-দুঃখ ২: জিএমপি’র ৪০ লাখ বাসিন্দার সেবায় ১১৫০ পুলিশ
গাজীপুরের সুখ-দুঃখ ১: ভয়াবহ যানজটে স্থবির টঙ্গী-গাজীপুর
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন