অগ্নিকাণ্ড: নজর শুধু গার্মেন্টসে, বাকি সব উপেক্ষিত
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত কয়েকদিনে পর পর দু’টি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে শ্রমিকের অগ্নি নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো।
শ্রমিক নেতারা বলেছেন, বিদেশী ক্রেতা বা আন্তর্জাতিক চাপের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণসহ নিরাপত্তা ইস্যুতে নজর দেয়া হয়েছে। কিন্তু গার্মেন্টস এর বাইরে অন্য খাতগুলোর কারখানায় শ্রমিকের অগ্নি নিরাপত্তার ব্যাপারে কারও কোনো নজর নেই।
সরকার এজন্য শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেছে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে গত ১১ই ডিসেম্বর যে প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ১৯জন শ্রমিক নিহত হয়েছে, সেই কারখানা চলছিল কোনো অনুমোদন ছাড়া।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ই ডিসেম্বর গাজীপুরে ফ্যান তৈরির একটি কারখানায় আগুনে পুড়ে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়। এই কারখানারও কোনো লাইসেন্স ছিল না বলে জানিয়েছেন দমকল বাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন।
গাজীপুরের কারখানাটি থেকে বেঁচে যাওয়া একজন শ্রমিক জাকির হোসেন বলছিলেন, তাদের কারখানায় নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।
“একটা বাসার মধ্যে কারখানাটা বানাইছে। কোনো দরজা নাই। একটাই দরজা। সিঁড়ি দিয়া সেই একটা দরজা দিয়াই নামতে হয়। আর দুই তলার পর তিন তলায় টিন দিয়া বেড়া দিয়ে সেখানে কাজ করা হয়। কারখানায় আগুন নিভানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।”
গাজীপুর বা কেরানীগঞ্জের কারখানা দু’টির মতো বিভিন্ন খাতের কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে বলে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে।
নজর শুধু গার্মেন্টস কারখানায়
কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী জলি তালুকদার বলছিলেন, গার্মেন্টস এর বাইরে অন্যান্য খাতের কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তা ইস্যু এখনও সবার দৃষ্টির বাইরেই থাকছে।
“অন্যান্য কারখানাগুলো যেহেতু আমাদের দৃষ্টি গোচরেই আসছে না, ফলে অনেক গিঞ্জি এলাকায় যেনতেনভাবে কারখানাগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে অগ্নি নিরাপত্তা বা শ্রমিকের কাজের পরিবেশের কোনো কিছুই বিবেচনা করা হচ্ছে না। এমনকি অন্য কারখানায় যেভাবে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটাও হচ্ছে না।”
“বাংলাদেশে এই যে নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে কারখানাগুলো গড়ে উঠছে। সে ব্যাপারে সরকার একেবারেই উদাসীন।”
শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন একটি বেসরকারি সংগঠন বিলস-এর কোহিনূর মাহমুদ বলছিলেন, সরকারি গবেষণা অনুযায়ীই দেশে প্রায় ৬কোটি শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৫ লাখের মতো গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করলেও বড় অংশই অন্যান্য খাতের কারখানায় কাজ করেন।
মি. মাহমুদ মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বাধ্য হয়েই সকলে গার্মেন্টস শিল্পে নজর রাখছে। সেজন্য এই শিল্পের কারখানাগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তাসহ পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অন্য খাতের কারখানায় কারও কোনো নজর নেই বলেই তারা গবেষণায় দেখতে পাচ্ছেন।
“যেহেতু আরএমজি সেক্টর রপ্তানিমুখী শিল্প। এটার সাথে বিদেশি বায়ার জড়িত। ফলে সকল কর্মকাণ্ড মনে হচ্ছে আরএমজি সেক্টর ঘিরেই। কিন্তু এর বাইরে যে প্রচুর কলকারখানা রয়েছে, সে ব্যাপারে নজরদারির কোনরকম ব্যবস্থা নাই। এই যে পর পর দু’টি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো, সেখানে মানুষের কাজ করার কোনো পরিবেশই ছিল না। কিন্তু কারও নজরদারি নেই।”
মালিকদের দুষলেন মন্ত্রী
পরিস্থিতির জন্য শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করলেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন।
মন্ত্রীও স্বীকার করেন যে, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সবার নজর রয়েছে গার্মেন্টস এর দিকে।
তিনি বলছিলেন, “কিছুটা মালিক পক্ষ থেকে গাফিলতি আছে। আমরা ব্যবসার জন্য একটা কারখানায় এত টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু যেটা অত্যন্ত জরুরি, যেটা অ্যাকর্ড- অ্যালায়েন্স এবং বিদেশীরা চাপ দিয়ে গার্মেন্টসকে করালো, সেটা অন্য জায়গায় হচ্ছে না।”
“এখন ব্যক্তি মালিকানায় ছোট ছোট যে কারখানাগুলো আছে, তারা নিয়মকানুন মানে না। আমাদের লোক পরিদর্শনে গেলে তারা বলে ঠিক করে ফেলবে। কিন্তু পরে তারা তা করে না। আসলে মালিকদের গাফিলতি আছে।”
শিল্প মালিকরা পাল্টা দায় চাপাচ্ছেন সরকারের ওপর।
ব্যবসায়ী এবং শিল্প মালিকদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনুতাকিম আশরাফ বলছিলেন, “আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারি। কিন্তু কার লাইসেন্সের শর্ত কি, কে কোন নিয়ম মানছে না, এসবতো সরকারকেই দেখতে হবে।”
এদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া কোনো কারখানার লাইসেন্স না দেয়াসহ বিভিন্ন নীতিমালা আছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয় এবং লোকবলের অভাব রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি