আলোচিত

যায় যায় অবস্থায় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বহরে পর্যাপ্ত উড়োজাহাজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে দুটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। বিদ্যমান রুটেও ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। এ অবস্থায় বন্ধের আশঙ্কায় রিজেন্টের যাত্রী পরিবহন না করতে সব স্টেশনে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বেসরকারি এয়ারলাইনসটির টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখেছে অধিকাংশ ট্রাভেল এজেন্সিও।

এয়ারলাইনসটির কার্যক্রম শুরুর পর কখনই এতটা সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি বলে জানান চট্টগ্রামভিত্তিক হাবিব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজের (এইচজি এভিয়েশন লিমিটেড) একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, বহরে চারটি উড়োজাহাজের মধ্যে বসে গেছে দুটি। কিন্তু ফ্লাইট চলুক আর না চলুক লিজে আনা চারটি উড়োজাহাজের জন্য ঠিকই নিয়মিত অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার ফ্লাইট কমিয়ে আনায় টিকিট বিক্রি বাবদ আয়ও হ্রাস পেয়েছে। অর্থাভাবে নিয়মিত বেতন হচ্ছে না কর্মীদের।

রিজেন্ট এয়ারওয়েজের এ দুরবস্থায় সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে এয়ারলাইনস খাতসংশ্লিষ্টরা। রিজেন্ট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা করে গত নভেম্বরে বিদেশের স্টেশনগুলোয় সতর্কবার্তা পাঠিয়ে চিঠি দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগ থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ইন্টারাপশন মেনিফেস্টো (এফআইএম) গ্রহণ না করতে বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এ নির্দেশনা পরিপালনের নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি অতীতে এফআইএম চুক্তির আওতায় রিজেন্টের কোনো যাত্রী পরিবহন করে থাকলে সে বাবদ বকেয়া রয়েছে কিনা স্টেশন কর্মকর্তাদের তা জানাতে বলেছে বিমানের বিপণন বিভাগ।

এফআইএম হলো দুটি এয়ারলাইনসের মধ্যে সম্পাদিত যাত্রী পরিবহন চুক্তি। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আয়াটা) মধ্যস্থতায় এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে এ চুক্তি হয়। এর আওতায় কোনো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বাতিল হলে তার যাত্রীদের অন্য এয়ারলাইনসটি পরিবহন করে। এসব যাত্রী পরিবহনের অর্থ আয়াটার মাধ্যমে চুক্তির সময় নির্ধারিত মূল্যে পেয়ে যায় যাত্রী পরিবহনকারী এয়ারলাইনসটি।

তবে রিজেন্টের যাত্রী পরিবহন না করার বিষয়ে বিমানের এ সিদ্ধান্ত অন্যায্য ও আইনানুগ নয় বলে মনে করছে বেসরকারি এয়ারলাইনসটি।

রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিমানের সঙ্গে এফআইএম চুক্তি হয়েছে আয়াটার মাধ্যমে। এফআইএম বিল এয়ারলাইনসগুলো একে অপরের থেকে সরাসরি নেয় না। আয়াটার ক্লিয়ারিং হাউজের মাধ্যমেই বিল পরিশোধ হয়। আয়াটা থেকে রিজেন্টের বিষয়ে সতর্ক করে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তার পরও বিমান কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত দুঃখজনক।

জানা গেছে, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের বহরে রয়েছে চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ। এর মধ্যে তিনটি উড়োজাহাজের সি-চেক (বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ) করার সময় চলে এসেছে। এরই মধ্যে একটি উড়োজাহাজের সি-চেক সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি উড়োজাহাজ সি-চেকের জন্য পাঠানো হবে আগামী মাসের শেষদিকে। এজন্য এয়ারলাইনসটিকে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। তবে কিছুদিন আগে হঠাৎ করে দুটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বসে যায়। তা মেরামতের জন্য এয়ারলাইনসটিকে বাড়তি ১ কোটি ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। আর বার্ষিক বাজেটে ১ কোটি ডলার খরচ করার পরিকল্পনা না থাকায় হঠাৎ করেই আর্থিক সংকটে পড়েছে এয়ারলাইনসটি। পাশাপাশি বহরে উড্ডয়ন সক্ষম উড়োজাহাজ কমে যাওয়ায় ফ্লাইট সংখ্যাও কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে তারা।

ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুর রুটে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। সীমিত করা হয়েছে দোহা, মাসকাট, কুয়ালালামপুর ও কলকাতা রুটের ফ্লাইটও। এদিকে উড়োজাহাজ সংকটে অনেক আগে থেকেই দেশের অভ্যন্তরে ঢাকা-যশোর ও ঢাকা-সৈয়দপুর রুটের ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে এয়ারলাইনসটি। অভ্যন্তরীণ রুটের উপযোগী নতুন উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রুট দুটি চালুর সম্ভাবনাও নেই। অভ্যন্তরীণ রুটের মধ্যে ঢাকা-কক্সবাজার রুটের সপ্তাহে চালানো হচ্ছে মাত্র তিনটি ফ্লাইট। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ফ্লাইটগুলো চলছে মূলত মধ্যপ্রাচ্য রুটের কানেক্টিং ফ্লাইট হিসেবে।

কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে আসায় অনিশ্চয়তার কারণে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের টিকিট বিক্রি থেকে বিরত থাকছে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি।

আর্ক ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আহসান হাবিব বলেন, আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীরা অনেক আগে থেকেই টিকিট কাটেন। কিন্তু কোনো কারণে ফ্লাইট বাতিল হলে যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিতে হয়, যা যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সির জন্যও ভোগান্তির। এ কারণে ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো ধরনের গুঞ্জন শোনা গেলে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো সেই এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রি করতে চায় না। সম্প্রতি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ বেশকিছু রুটের ফ্লাইট কমিয়ে এনেছে। ওইসব ফ্লাইটের বিক্রি হওয়া টিকিটের যাত্রীদের অন্য এয়ারলাইনসের মাধ্যমে পরিবহন করা হবে অথবা অর্থ ফেরত দিতে হবে, যা ভোগান্তির। এ কারণে যাত্রীদের কাছে সহসা রিজেন্টের টিকিট বিক্রি করছি না আমরা।

উড়োজাহাজের পাশাপাশি অনেক আগে থেকেই রিজেন্ট এয়ারওয়েজে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এয়ারলাইনসটিতে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে ৭০০-এর বেশি জনবল রয়েছে। এর মধ্যে বৈমানিক রয়েছেন প্রায় ৫০ জন। অর্থ সংকটের কারণে তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে এয়ারলাইনসটি। আবার অভ্যন্তরীণ রুট চালু করতে কমপক্ষে দুটো টার্বোপ্রপ উড়োজাহাজ দরকার। এজন্য এয়ারলাইনসটির নগদ অর্থের প্রয়োজন। অর্থ সংগ্রহে বিভিন্ন সময়ে বিনিয়োগকারীও খুঁজেছে এয়ারলাইনসটির মালিক পক্ষ। যদিও দায় বেশি হওয়ায় এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনতে আগ্রহী হয়নি কেউ।

আর্থিক সংকট প্রসঙ্গে ইমরান আসিফ বলেন, হঠাৎ করে দুটো উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বসে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে। তবে আগামী দুই মাসের মধ্যেই এটা সমাধান হয়ে যাবে। ১৬ ডিসেম্বর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ইন্দোনেশিয়া পাঠানো হবে, যা জানুয়ারির মাঝামাঝি চলে আসবে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ আরেকটি উড়োজাহাজ সি-চেকের জন্য পাঠানো হবে। যেটি ফেব্রুয়ারির মধ্যে বহরে যুক্ত হবে। উড়োজাহাজগুলো বহরে এলেই কমিয়ে আনা ফ্লাইটগুলো আবার শুরু করা হবে।

তিনি বলেন, দুটি উড়োজাহাজ না চললেও লিজের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার ফ্লাইট কমায় টিকিট বিক্রি বাবদ রাজস্ব কমে গেছে। সে কারণে কোনো কোনো মাসে কর্মীদের বেতন পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। তবে এটি সাময়িক।

জানা গেছে, অর্থ সংকটের কারণে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাবদ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বড় অংকের পাওনা পরিশোধ করছে না রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। গত ৪ মার্চ বেবিচকের অর্থ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক হিসাবে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারের কাছে বিল বাবদ পাওনা হয়েছে ১১৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা জরিমানাসহ তা দাঁড়িয়েছে ১৮৪ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে টিকিট বিক্রি করে যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া সরকারি রাজস্ব সময়মতো পরিশোধ না করায় গত বছর জুনে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছিল ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের টঙ্গী ভ্যাট বিভাগ।

যদিও সময়মতো ফ্লাইট পরিচালনা করে দেশীয় এয়ারলাইনস হিসেবে শুরুর দিকে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে কার্যক্রমে আসা চট্টগ্রামভিত্তিক হাবিব গ্রুপের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজ (এইচজি এভিয়েশন লিমিটেড)।

 

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button