কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার দিকে বাংলাদেশ?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশে গত এক দশকের রাজনীতি কী নতুন ধারার ইঙ্গিত দিচ্ছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, খুব অল্পসংখক মানুষই এখন গণতন্ত্র এবং রাজনীতি নিয়ে ভাবছেন। আর এই পরিস্থিতি বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার দিকে।
আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। সংসদে নেই কার্যকর বিরোধী দল। মাঠেও রাজনৈতিক বিরোধী শক্তির কোনো সরব উপস্থিতি নেই। ফলে আওয়ামী লীগের জন্য বলতে গেলে খোলা মাঠে গোল দেয়ার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন সংসদীয় রাজনীতির খরা চলছে। এর থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের দরকার এমন সরকারি দল, এমন বিরোধী দল যারা কোনো ঘোরপ্যাঁচ না করে, কোনো চালাকি না করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে।”
বাংলাদেশে এখন একপাক্ষিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শান্তনূ মজুমদার বলছেন, ‘‘রাজনীতি যদি একপাক্ষিক হয়ে যায় তাহলে হয়তো আমরা নতুন কোনো মডেল দেখতে পারি। আমাদের সামনে সিঙ্গাপুর মডেল আছে, চীন ও মালয়েশিয়া মডেল আছে৷ সেগুলো যে ভালো মডেল তা আমি বলবো না। তবে অর্থনীতিকে হয়তো একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ডমিনেন্ট পার্টি সিস্টেম, যদি একদলীয় না বলি, ডমিনেন্ট পার্টি সিস্টেমে একটা যায়গায় যাওয়া সম্ভব।”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মত গণতন্ত্র চাই তাহলে আমাদের গণতন্ত্র তো বহুদলীয় হতে হবে। এই সময়ে ডমিনেন্ট পার্টির তকমায় আওয়ামী লীগের সামনে হয়তো তেমন চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি মনে করি তাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ আছে। তাদের দল হয়তো অনেকে করেন বলছেন৷ কিন্তু তাদের যে আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সেটা কতটা ধারণ করে এটা একটা বড় প্রশ্ন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সামাজিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশে সেই অর্থে বিরোধী দল নেই। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি বা বিরোধী দল নয়, শ্রেণী দিয়ে বুঝতে হবে। আমাদের দেশে প্রধান চারটি শ্রেণী আছে। সবার উপরে সেনাবাহিনী৷ যাদের কোনো পরিবর্তন হয়না রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে। এর পর আছে আমলা শ্রেণি, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক শ্রেণী। রাজনৈতিক শ্রেণীই আমাদের দেশে সবচেয়ে দুর্বল। রাজনৈতিক শ্রেণী পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই শ্রেণীটা একবার ক্ষমতায় বসলে কোনো দিনই স্বেচ্ছায় পরিবর্তিত হতে চাইবে না৷ এটা আমাদের ইতিহাস।”
তিনি এর সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কও দেখছেন। তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতিতে যদি প্রতিযোগিতা থাকে তাহলে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে সেই প্রতিযোগিতা নেই। এটা বাজার অর্থনীতি নয়, যোগাযোগ ভিত্তিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষমতায় আসে, তারা মৌলিক কী পরিবর্তন করতে পারবে? প্রশাসন তো একই থাকবে। তাহলে তো আমাদের রাষ্ট্রের কাঠামোতে বিরোধী দলের ভূমিকা ক্রমেই গৌণ হতে থাকবে।”
ক্ষমতাবানদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই এখন বাংলাদেশে সবকিছু হচ্ছে বলে মনে করেন আপসান চৌধুরী। দেশের অধিকাংশ মানুষ এখন রাজনীতির বাইরে বলেও মনে করেন তিনি।
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘ক্ষমতবানদের মধ্যে সমঝোতা অনেক ভালো৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাজনীতি থেকে বাদ পড়ে গেছে। এই মধ্যবিত্তরাই বিরোধী দল খুঁজছে৷ গরিব মানুষ এই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে না। শহরেরর এই রাজনীতির কোনো প্রভাব গ্রামে পরছে না। গ্রাম থেকে শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিনা এটা দেখা দরকার। গ্রামের অর্থায়ন হচ্ছে রেমিটেন্সের মাধ্যমে৷ গ্রাম এখন শহর থেকে আলাদা থাকতে চাইবে৷ গ্রামের আলাদা সংস্কৃতি, আলাদা শক্তি তৈরি হয়ে গেছে। গ্রামের কিছু আসে যায় না কে ক্ষমতায় আসলো, কে ক্ষমতায় থাকলো তা নিয়ে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ হলো গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের মূলই ছিলো গ্রাম। সেই গ্রামই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, সেই গ্রাম আরো স্বাধীন।”
বাংলাদেশে এখন যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন তারা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান আফসান চৌধুরী। তার মতে, ‘‘এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের কী হবে এটাতো মধ্যবিত্তের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন তো গরীব মানুষ করে না. ধনীরা জিজ্ঞেস করে না। এতদিন মধ্যবিত্ত গরিব মানুষের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করেছে। তারা এখন আর মধ্যবিত্তের সাথে নাই। ফলে রাজনীতি এখন ছোট্ট একটা শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারাই গণতন্ত্র নিয়ে কষ্ট পায়। তাদের ভূমিকা এখন গৌণ হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে নয়, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে মধ্যবিত্তের বড় ভূমিকা ছিলো। কিন্তু এখন তার ভূমিকা নেই বললেই চলে। ফলে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তা করছে।”
গণতন্ত্র চর্চা এখন রাজপথ না সংসদ নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে এসেছে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘এখন গণতন্ত্রের চর্চাটা স্যোশাল মিডিয়ায় হচ্ছে। তবে দেখা দরকার এটা কতটা গণতন্ত্রিক৷ আমাদের এখন পুরনো চিন্তায় থাকলে হবে না। গণমাধ্যম কিন্তু এখন আর গণমাধ্যম নাই, এখন সামজিক গণমাধ্যম।”
তার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ হলো, ওপর তলার মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধিতা তৈরি না হলে বিরোধী দলও থাকে না। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণভাবে আমরা সরকারি দল-বিরোধী দল দেখি। এরা ওপর তলার৷ এই ওপর তলার মধ্যে সংকট বা বিরোধিতার কারণে সরকারি দল থাকে, বিরোধী দল থাকে। কিন্তু আমাদের এখানো ওপর তলার মধ্যে ভালোই সমঝোতা আছে।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে