ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা গাজীপুর
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা গাজীপুর। রাজধানী সীমানা সংলগ্ন জেলা গাজীপুরে বেড়াতে এলে দিনে দিনেই ফেরা সম্ভব। সারা দেশ থেকে এখানে ট্রেন, বাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বেড়ানোর সুবিধা রয়েছে। ইচ্ছে করলে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গাজীপুরে পিকনিকও করতে পারেন। ইতোমধ্যে জেলার দর্শনীয়স্থান এবং রিসোর্টগুলোতে পর্যটক এবং পিকনিক পার্টির আগমন শুরু হয়ে গেছে।
প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শাল-গজারি বনে ঘেরা গাজীপুরের ‘ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান’ যেন সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। শিল্পশহর গাজীপুরে রয়েছে হাজার হাজার শিল্পকারখানা। রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিমানের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেড়াতে এলে দেখতে পাবেন ভাওয়ালের রাজবংশের তৈরি প্রায় অক্ষত ভাওয়াল রাজবাড়িসহ বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ি. শ্মশান মন্দির (শ্মশানবাড়ি)।
এছাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, টাকা ছাপানোর টাকশাল, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, সমরাস্ত্র কারখানা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আনসার একাডেমি, বঙ্গবন্ধু আইসিটি পার্ক। ব্যাক্তিগত উদ্যাগেও জেলার বিভিন্নস্থানে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকশত পিকনিক স্পট-রিসোর্ট। জেলা দিয়ে বহমান বহ্মপুত্র, চিলাই, বালু ও পারুলী নদী দিয়ে নৌ-ভ্রমণও করতে পারবেন।
গাজীপুর জেলার দক্ষিণে ঢাকা, পশ্চিমে টাঙ্গাইল, উত্তরে ময়মনসিংহ এবং পূর্বে নরসিংদী জেলা। ট্রেন ও সড়ক পথে এ জেলায় সহজে আসতে পারবেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন, ঢাকা-রাজশাহী রেললাইস, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন, ঢাকা-সিলেট রেললাইন এই জেলার উপর দিয়ে গেছে। ফলে দেশের যে কোনো জেলা থেকে ট্রেনে বা সড়ক পথে সহজে এ জেলায় আসা যায়।
তাছাড়া জেলার সঙ্গে প্রতিটি উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। শহরের বা উপজেলায় চলাচলের জন্য রয়েছে রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেট/মাইক্রোবাস। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বেশি থাকায় শহর এলাকায় যানজট বেশি। শহরের ভিতরে র্যাটারিচালিত অটোর ভাড়া ১০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। ইচ্ছে করলে প্রতি ঘণ্টায় রিকশা ১০০ থেকে ১২০ টাকা ভাড়ায় নিয়ে ঘুরতে পারবেন। শহরের শিববাড়ীমোড়, চান্দনা চৌরাস্তা, বোর্ডবাজার, টঙ্গীসহ উপজেলা শহর এলাকাগুলো থেকে প্রাইভেট/মাইক্রোবাস, অটোরিকশা ভাড়া পাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রবেশ করলে আব্দুল্লাহপুর পেরুলে গাজীপুরের টঙ্গী। আর ট্রেনে বিমানবন্দর স্টেশনের পরেই টঙ্গী জংশন। ঐতিহাসিক সোনাবানের কহদর দরিয়া (তুরাগ নদী একাংশ), মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশের বিশ্ব ইজতেমা ময়দান, বিসকি শিল্প নগরীর বিভিন্ন শিল্প কারখানা দেখতে পাবেন এখানে।
আরো কিছু দূর অগ্রসর হলে বোর্ডবাজারে মহাসড়কের পশ্চিমপাশে পাশাপাশি দেখতে পাবেন তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হল- ওআইসি পরিচালিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অগ্রসর হলে পাবেন চান্দনা চৌরাস্তা। এখানে ঢাকা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-গাজীপুর মহাসড়কের সংযোগস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কার্যের ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’; লুঙ্গি পরা, ডান হাতে গ্রেনেড, বাম হাতে রাইফেল নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধা। শ্বেতপাথরে নির্মিত ভাস্কর্যটির নকশা করেন তৎকালীন ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। তার সহকারী ছিলেন হামিদুজ্জামান, ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম আব্দুর রশিদ, এম আহম্মদ এবং মোঃ আঃ হক।
সেখান থেকে উত্তরে সালনা এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। আরেকটু অগ্রসর হলে পাবেন ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক)। মহাসড়কের দুই পাশে এই উদ্যানের অবস্থান। শাল-গজারি গাছে সুশোভিত বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে রয়েছে পায়ে হাঁটা সরু পথ। দুই পাশে সারি সারি গজারি গাছের ফাঁক গলে ঝিরিঝিরি বয়ে যাওয়া বাতাসে শরীর-মন শীতল হয়ে আসে। দূর থেকে ভেসে আসে নানান পাখির কুহুতান। বনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখনো বা মনে হতে পারে-এ পথ যদি না শেষ হতো! আবার কোথাও কোথাও আকাঁ-বাঁকা লেক হারিয়ে গেছে বনের গভীরে। মৃদু বাতাসে লেকে যে ছোট ছোট ঢেউ জাগে তা নাড়া দিয়ে যায় অনেকের মন। লেকের স্থানে স্থানে ফুটে থাকা লাল শাপলা আর শালবনের ফাঁকে ফাঁকে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ফুটে থাকা ফুলের লাল আভা রাঙিয়ে যায় হৃদয়-মন।
ভ্রমণ পিপাসু-পিকনিক পার্টির সুবিধার জন্য উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে তৈরি করা হযেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য রেস্ট হাউজ, কটেজ, কৃত্রিম লেক, বাঁধানো ঘাট। পার্কের লেকে ভ্রমণের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি নৌকা।
রেস্টহাউজগুলোর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। যেমন চম্পা, অর্কিড, জেসমিন, শাপলা, মালঞ্চ ও রজনীগন্ধা। বনের মাঝে রয়েছে কিছু পাকা শেডের বিশ্রামস্থান। ওপর থেকে পুরো উদ্যান দেখার জন্য রয়েছে সুউচ্চ অবজারবেশন টাওয়ার। এ উদ্যানের প্রবেশের জন্য ছয়টি প্রবেশপথ থাকলেও ৩নং প্রবেশ পথকেই উদ্যানের মূল প্রবেশপথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরেকটু অগ্রসর হলে পাবেন বাঘেরবাজার। সেখান থেকে আনুমানিক ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ইন্দ্রপুর এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কে বাঘ, সিংহ, ভল্লুক, কুমির, জলহস্তির মতো হিংস্র প্রাণীসহ হাতি, জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ক্যাঙ্গারু, ময়ূর এখানে উন্মুক্ত পরিবেশে থাকে। স্ত্রী-বাচ্চাদের কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সাফারি পার্ক। হিংস্র প্রাণী দেখার জন্য পার্কে রয়েছে সুরক্ষিত বাসের ব্যবস্থা।
তা ছাড়া জাতীয় উদ্যানে পিকনিক করে নিকটবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে পূর্বদিকে জেলা শহর। ঢাকা-গাজীপুর সড়ক ধরে কিছু দূর এগুলে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর পূর্বসীমানা ঘেষা বাংলাদেশ কৃষিগবেষণা ইনস্টিটিউট। এর পরে জেলার শহর। শহরের শিববাড়ি-শিমুলতলী রাস্তা ধরে এগুলে পাবেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ও টাকশাল।
জেলা শহরে রয়েছে ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজবাড়ী। এর পাশে উত্তরছায়াবীথি এলাকায় ভাওয়াল শ্মশান মন্দির (শ্মশানবাড়ি)। রাজবাড়ি সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বদিকে গাজীপুর সদর উপজেলার বলদা এলাকায় ঐতিহাসিক বলদা জমিদার বাড়ি। অবশ্য বাড়িটি এখন আর নেই। রয়েছে জমিদারদের পূজা অর্চনার মন্দিরের অংশ বিশেষ।
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দিয়ে পশ্চিমে ৫ কিলোমিটার গেলে পাবেন বিসিক শিল্পনগরী কোনবাড়ি। এ মহাসড়কের দুই ধারে এবং কোনাবড়িতে রয়েছে শত শত শিল্প কারখানা। পরেই কাশিমপুর এলাকায় কাশিমপুর কারা কমপ্লেক্স। এখানে রয়েছে ৪টি কেন্দ্রীয় কারাগার।
একই সড়কে সদর উপজেলা পেরিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাকে জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আনসার একাডেমি এবং বঙ্গবন্ধু আইসিটি পার্ক, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য গাবতলী-নবীনগর-চন্দ্রা হয়েও এ এলাকায় যাওয়া যায়। এ ছাড়া দেখতে পারবেন বলিয়াদী ও শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি। বেড়াতে বা পিকনিক করতে পারেন উপজেলার বিভিন্নস্থানে গড়ে ওঠা পিকনিক স্পট-রেস্টহাউজে। সফরসঙ্গীদের নিয়ে স্বাদ নিতে পারেন কালিয়াকৈরের দই ও ঢেঁকি ছাঁটা চিড়ার।