সারাদেশ

বালি উত্তোলনে সুরমা তীরে ভাঙন: ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব পেতে ১৩৪ কোটি টাকা ব্যয়!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলার মধ্যবর্তী তিলকপুর থেকে শিবেরখাল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। নদীর এ ২০ কিলোমিটার এলাকার কয়েকটি জায়গা বালি উত্তোলনের জন্য পাঁচ বছর ধরে ইজারা দিয়ে আসছে জেলা প্রশাসন। প্রতি বছর ইজারা থেকে রাজস্ব আয় হয় ১৬ লাখ টাকা। ফলে গত পাঁচ বছরে এ বালুমহাল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। তবে ইজারা নেয়ার পর ইজারাদাররা নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকেও অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের ফলে ২০ কিলোমিটারজুড়ে নদীর দুই তীরে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙনে এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এ অবস্থায় নদীভাঙন ঠেকাতে প্রতিরক্ষা দেয়াল (গার্ড ওয়াল) নির্মাণে দুই বছরে ১৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে ও অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের ফলেই নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে নদীতীরবর্তী জনপদ, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। তাই বালি উত্তোলনের জন্য নদী ইজারা দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

ইজারা নিয়ে এ নদী থেকে দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন করছেন অ্যাডভোকেট নাসিম আহমদ নামের এক ব্যক্তি। সিলেট নগরীর সুবিদবাজারের বাসিন্দা নাসিম তার বড় ভাই মশউদ আহমদের লাইসেন্স দিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন। এর আগে আরো তিন বছর বালি উত্তোলন করেছেন নুরুল হুদা নামের অন্য এক ব্যবসায়ী।

জানা গেছে, অবাধে বালি উত্তোলনের কারণে গত পাঁচ বছরে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বিশ্বনাথের পরগনা বাজারের কিছু এলাকা, বাজারের মসজিদ, দুটি মাজার, লামাকাজি-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক ও লামাকাজি-পরগনাবাজার-আকিলপুর সড়কের কিছু অংশসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এছাড়া বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের মহাতাবপুর, রাজাপুর, আকিলপুর, কলিম উল্লাহপুর, সুবলপুর, রসুলপুর, হাজারীগাঁও, তিলকপুরসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ভাঙনের শিকার হচ্ছে।

নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় ২০১৮ সালে নদীভাঙন রোধে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপর নদীর দুই তীরে ব্লক ফেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে এতেও ভাঙন বন্ধ না হওয়ায় চলতি বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় নদীর এ এলাকার ভাঙন রোধে ১২০ কোটি ৮২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদী থেকে বালি উত্তোলন প্রয়োজন আছে। কিন্তু অনেকে ইজারা নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে ও নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকে বালি উত্তোলন করে। ফলে ওই এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন লামাকাজিতে নদীভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর এক পাড়ে একসঙ্গে চারটি নৌকা দিয়ে সুরমা নদী থেকে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। আর অন্য পাড়ে আরো দুটি নৌকা দিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে হাজরাই গ্রামে মজুদ করছেন ওই গ্রামেরই বাবুল মিয়া নামের এক ব্যক্তি। নদীর পাশ দিয়েই গেছে লামাকাজি-পরগনাবাজার-আকিলপুর ভাঙা সড়ক। সড়কের মাঝ বরাবর ভেঙে প্রায় অর্ধেক হেলে পড়েছে নদীতে। এ সড়ক দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলছে রিকশা-অটোরিকশা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ইজারাদারদের পাশাপাশি কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও এ এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করেন। দিনে-রাতে ১০-১৫টি নৌকায় ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হয়। এসব ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দের কারণে রাতে ঘুমাতেও পারে না স্থানীয়রা।

স্থানীয় রাজাপুরের বাসিন্দা সজ্জাদ চৌধুরী লিলু ও আকিলপুরের ইমন আহমদ বিজয় বলেন, সরকার একদিকে নদীভাঙন প্রতিরোধে শতকোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে, অন্যদিকে বালুমহাল ইজারা দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনকে বৈধতা দিচ্ছে। এভাবে বালি উত্তোলন বন্ধ না করলে এ এলাকার ভাঙন ঠেকানো যাবে না।

জানতে চাইলে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্ণালী পাল এ প্রসঙ্গে বলেন, বালি উত্তোলনের সীমানা নির্ধারণসহ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছি।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button