ভোগান্তি কমাতে নামজারি ও মিস কেস নিষ্পত্তির জন্য ১১ দফা নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : জমির নামজারির সঙ্গে সম্পৃক্ত আপিল বা মিস কেস নিষ্পত্তিতে সেবা প্রার্থীদের হয়রানির কোনো শেষ নেই। ভূমিসেবায় ঘুষ-অনিয়ম ছাড়াও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ও। এজন্য জনভোগান্তি কমাতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে নামজারি ও মিস কেস নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপরও জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অন্য কাজে ব্যস্ততা দেখিয়ে বারবার তারিখ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নামজারিসহ ভূমিসেবা সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করতে গত সোমবার পরিপত্র জারি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে মাঠ প্রশাসনকে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনো জমি কিনলে তা রেজিস্ট্রেশন বা দলিল করার পর ক্রেতার নামে এর নামজারি করতে হয়। আবার জমির মালিক মারা গেলে তার উত্তরাধিকারদের প্রত্যেকের নামেও জমির নামজারি করতে হয়। কোনো জমি কারও নামে নামজারির কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে
সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে রিভিউ বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে আপিল বা মিস কেস দায়ের করতে পারেন। নামজারি ও এ সংক্রান্ত আপিল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই জমির ওপর কারও নিষ্কণ্টক মালিকানা নিশ্চিত হয় না। প্রয়োজনে ওই জমি বিক্রি করলেও তা রেজিস্ট্রেশন করে দিতে পারেন না তিনি। মূলত আপিল নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রণালয় থেকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ আবেদনের নামজারিতে ২৮ কার্যদিবস, এলটি নোটিসের বুনিয়াদে নামজারিতে ২৮ কার্যদিবস, মহানগর এলাকায় প্রবাসীদের নামজারিতে ১২ কার্যদিবস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবাসীদের নামজারি ৯ কার্যদিবসে সম্পন্ন করতে সময় বেঁধে দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আপিল বা মিস কেস নিষ্পত্তি করতে গত ২ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রটি দেশের সব জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজস্ব সার্কেলকে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ভূমি সচিব মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, তা কোথাও কোথাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছিল না। কেউ কেউ অন্য কাজে ব্যস্ততা দেখিয়ে আপিল নিষ্পত্তিতে বিলম্ব করছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে জনগণকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবিড়ভাবে ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই জনগণকে যত কম অফিসে যাতায়াত করতে হয়, তাদের যাতে কোনো ধরনের হয়রানি না হয়। দেখা গেল, মামলার শুনানির দিন সেবাপ্রার্থী অফিসে এলো, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় শুনানি করলেন না। জনগণের এ ধরনের হয়রানি বন্ধে ও দ্রুততম সময়ে ভূমিসেবা নিষ্পত্তি করতে মামলার ‘কজ লিস্ট’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা, শুনানিতে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করে যথাসম্ভব পরবর্তী কার্যদিবসে তারিখ নির্ধারণ করাসহ পরিপত্রে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
বর্তমানে নামজারি ও ভূমিসেবা নিয়ে কী পরিমাণ আপিল বা মিস কেস মামলা রয়েছে, তার হালনাগাদ তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছেও। এ বিষয়ে ভূমি সচিব বলেন, মামলার পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। কী পরিমাণ মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে, প্রতি মাসে কী পরিমাণ মামলা নতুন হচ্ছে ও মাসে কতটি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য প্রতি মাসে মন্ত্রণালয় ও ভূমি সংস্কার বোর্ডে পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যান পাওয়ার পর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘নামজারিসহ ভূমিসেবা সংক্রান্ত আদেশের ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর রিভিউ অথবা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর আপিল বা মিস কেস দায়ের করে থাকেন। কর্মকর্তার স্বল্পতার কারণে কোনো কোনো জেলায় অন্যান্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরাও আপিল মোকদ্দমার শুনানি করে থাকেন। মূলত দ্রুত সেবা প্রদান এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যস্ততা বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করে বারবার তারিখ দেওয়া হয়। এতে আপিল মোকদ্দমাসমূহে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রায়ই অভিযোগ আসছে, যা অনভিপ্রেত।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অধস্তন দপ্তর নিয়মিত পরিদর্শনের সময় এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হলে জনগণের কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অনেক জেলায় গত ফেব্রুয়ারিতে জারি করা পরিপত্রের নির্দেশনা প্রতিপালনে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না বিধায় অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আদৌ কাম্য নয়।
১১ দফা নির্দেশনায় মন্ত্রণালয় বলেছে, সপ্তাহে অন্তত এক দিন সর্বোচ্চসংখ্যক মিস কেস শুনানির জন্য নির্ধারণ করতে হবে। স্বল্পতম সময়ের বিরতিতে শুনানির তারিখ ধার্য করতে হবে। ধার্য করা তারিখে প্রকাশ্যভাবে রায় ঘোষণা করতে হবে। মামলা শুনানির দিন প্রশাসনিক অন্যান্য কার্যক্রম যথাসম্ভব কম রাখতে হবে। কোনো কারণে শুনানির তারিখ পরিবর্তন হলে যথাসম্ভব পরবর্তী কার্যদিবসে তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। ই-রেজিস্ট্রার চালু করে মামলা মনিটরিং করতে হবে। কোনো মোকদ্দমার শুনানি করা সম্ভব না হলে তা সবপক্ষকে যথাসময়ে জানাতে হবে।
ভূমিসেবা নিতে যাওয়া মানুষের ৭০ ভাগই অসন্তুষ্ট বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০১৫ সালে করা ওই গবেষণায় তিনি বলেন, ভূমি কার্যালয়ে আসা প্রায় ৭০ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। দুই-তৃতীয়াংশ সেবাগ্রহীতা বলেছেন, ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়াই তাদের অসন্তোষের কারণ।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত বছরের এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে ভূমির অবস্থান পঞ্চম। জমিজমাসংক্রান্ত কাজ করাতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক মানুষকে ঘুষ দিতে হয়।