বন্যপ্রাণী পাচার ও বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র বাংলাদেশ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে, গড়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীজাত বিভিন্ন পণ্যের ক্রেতাশ্রেণী। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম প্রধান উৎসও হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘২০১৯ এন্ড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাফিকিং রিপোর্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বন্যপ্রাণী পাচারের ট্রানজিট ও প্রধান উৎস হিসেবে ২৮টি ফোকাস দেশের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দেশটির স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য দপ্তর এবং ইউএসএআইডির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ফোকাস দেশের এ তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় থাকা প্রতিটি দেশই বন্যপ্রাণী সংশ্লিষ্ট পণ্য পাচারের বড় উৎস, ট্রানজিট পয়েন্ট অথবা ভোক্তা দেশ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
বাংলাদেশও বন্যপ্রাণী পাচার চক্রের কাছে অন্যতম প্রধান উৎস ও ট্রানজিট দেশ। বাংলাদেশ থেকে তারা মূলত বেলজিয়াম, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে বন্যপ্রাণীজাত পণ্য পাচার করে থাকে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরেও একটি ক্রেতাশ্রেণী গড়ে উঠেছে তাদের।
বন্যপ্রাণীর পণ্য পাচারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ফোকাস তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, গ্যাবন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, লাওস, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, চীন, ফিলিপাইন, রিপাবলিক অব কঙ্গো, সাউথ আফ্রিকা, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, টোগো, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ে। এর মধ্যে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাওস ও মাদাগাস্কারের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব ওশানস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্সে জনসংযোগ কর্মকর্তা জেমস ডিউই উই বলেন, বন্যপ্রাণী পাচার রোধে মার্কিন সরকারের একটি আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স রয়েছে। এ টাস্কফোর্স ফোকাস দেশগুলো ও উদ্বেগজনক দেশগুলো নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টাস্কফোর্স দেশগুলোতে বন্যপ্রাণীর জব্দ তালিকা, আমদানি-রফতানি তথ্য, ইন্টারপোলের তথ্য, জাতিসংঘ এবং এনজিওগুলো থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোকে ফোকাস ও উদ্বেগজনক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
পাচারকালে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বে কতসংখ্যক অবৈধ বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িত কতজন চোরাকারবারি ধৃত বা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে, সেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের ৩৭৪টি ঘটনায় ৫৬৬ জন অপরাধী ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ১০১ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৩৭ হাজার ৫৭৫টি বন্যপ্রাণী, যার মধ্যে ২৬৮টি স্তন্যপায়ী, ১৭ হাজার ৫০১টি পাখি, ১৯ হাজার ৩৫৯টি সরীসৃপ ও ৪৪৭টি বড় জন্তু।
২০১২ সালে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারসংক্রান্ত ৪২টি ঘটনায় ১১৯ জন জড়িত ছিল। অপরাধীদের আটজনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মোট ২ হাজার ২৬টি বন্যপ্রাণী, যার মধ্যে ১৫টি স্তন্যপায়ী, ৯৬১টি পাখি, ১ হাজার ১০টি সরীসৃপ ও ৪০টি বড় জন্তু।
২০১৩ সালে ৩৪টি পাচার চেষ্টার ঘটনায় জড়িত ৬৫ অপরাধীর মধ্যে ১১ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৫ হাজার ৫৬০টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে ছিল ৪৫টি স্তন্যপায়ী, ২ হাজার ২৫৩টি পাখি, ৩ হাজার ২৫৯টি সরীসৃপ ও তিনটি বড় জন্তু।
২০১৪ সালে ৬৮টি ঘটনায় ১৪৬ জন জড়িত অপরাধীর মধ্যে ৩৫ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৮ হাজার ১৫১টি বন্যপ্রাণী, যার মধ্যে ৫৪টি স্তন্যপায়ী, ২ হাজার ২৩০টি পাখি, ৫ হাজার ৭০০টি সরীসৃপ ও ১৬৭টি বড় জন্তু ছিল। ২০১৫ সালে ১৩০টি ঘটনায় ১৭১ জন অপরাধীর মধ্যে ২৯ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ হাজার ১৩৯টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে ছিল ৬১টি স্তন্যপায়ী, ৩ হাজার ৮৯৭টি পাখি, ৮ হাজার ৯৯৭টি সরীসৃপ ও ১৮৪টি বড় জন্তু।
২০১৬ সালে ১০০টি ঘটনায় ৬৫ জন জড়িত ছিল। অপরাধীদের ১৮ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৮ হাজার ৬৯৬টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে ছিল ৯৩টি স্তন্যপায়ী, ৮ হাজার ১৫৭টি পাখি, ৩৯৩টি সরীসৃপ ও ৫৩টি বড় জন্তু।
তালিকায় থাকা কিছু দেশ এরই মধ্যে বন্যপ্রাণী পাচার রোধে যত্নশীল হয়ে উঠছে বলেও জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এসব দেশকে মূল্যায়নের মাধ্যমে মার্কিন দূতাবাসগুলো পরিকল্পনা কৌশল প্রণয়ন করেছে। গত বছর মার্কিন দূতাবাসগুলো ২৬টি ফোকাস দেশকে চিহ্নিত ও পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কৌশল প্রণয়ন করেছে। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন পর্যালোচনা ও কৌশল কিছু দেশের সরকারের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী পাচারের কেন্দ্র হয়ে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, ‘দুই হাজারের ওপর খাল রয়েছে সুন্দরবনে। এ খাল পাহারা দেবে কে? আমার লোকবল কত রয়েছে? তার পরও আমরা চেষ্টা করছি। এ অপ্রতুল লোকবল দিয়ে যতটুকু সম্ভব আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে।’
সূত্র: বণিক বার্তা