গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অপ্রতুল জনবল নিয়েও আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ পুলিশ। তবে সক্ষমতার চেয়েও অতিরিক্ত সেবা দিতে গিয়ে দীর্ঘ ডিউটি করতে হচ্ছে তাদের। সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টার রুটিন ডিউটি শেষে বিশেষ ডিউটিও করতে হচ্ছে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের। নিয়মিত এ ডিউটির বাইরে মামলার তদন্তকাজ এবং পরোয়ানা তামিল করতে হচ্ছে এ বাহিনীর সদস্যদের। এতে তদন্তের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হচ্ছে, যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন নিরপরাধ ব্যক্তিরা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, তদন্তের জন্য গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে, যা অপারেশনাল পুলিশের (থানায় নিয়মিত কার্যক্রমে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা) নেই। আবার মাঠ পর্যায়ের অপরাধ দমনে যে ধরনের দক্ষতা অপারেশনাল পুলিশের রয়েছে, তা তদন্তের জন্য গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর নেই। পাশাপাশি থানায় মামলার তদন্ত করে থাকেন পুলিশের উপপরিদর্শক বা সহকারী উপপরিদর্শক। এক্ষেত্রে তদারকি করে থাকেন একজন পরিদর্শক। কিন্তু তদন্তের জন্য গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটগুলোয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন একজন পরিদর্শক। আর তদারকিতে থাকেন অতিরিক্ত বা সহকারী পুলিশ সুপার।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দিন ও রাত মিলিয়ে ১২ ঘণ্টার দুটি শিফটে ভাগ করে থানা পুলিশকে ডিউটি করতে হয়। ট্রাফিক বিভাগকেও একই রোস্টারে ডিউটি পালন করতে হয়। এর বাইরে বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ডিউটি রোস্টার থাকে না। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা কখনো ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা, কখনো কখনো ১৬ ঘণ্টাও ডিউটি পালন করে থাকেন।
তবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানার ডিউটি হয় দুই শিফটে। সকাল ৮টায় শুরু হয়ে শেষ হয় রাত ৮টায়। আবার রাত ৮টায় শুরু হয়ে শেষ হয় সকাল ৮টায়। কাগজে-কলমে ১২ ঘণ্টার শিফট ডিউটির কথা উল্লেখ থাকলেও প্রয়োজনভেদে ১২ ঘণ্টার ডিউটি ১৬ ঘণ্টা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ ঘণ্টাও ডিউটি করতে হয়। নির্ধারিত এ শিফট ডিউটির পর মামলার তদন্ত ও পরোয়ানা তামিলের কাজও করতে হয় পুলিশ সদস্যদের। এতে তদন্ত কাজে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না কর্মকর্তারা। ফলে অনেক সময়ই নির্ভুল তদন্তও সম্ভব হচ্ছে না। আবার পরোয়ানা তামিলে আসামি শনাক্তেও ভুল হচ্ছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীর বদলে সাজা ভুগতে হচ্ছে নিরপরাধ ব্যক্তিকেও।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা যায়, কয়েকটি মামলা তদন্ত করে থানা পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র আমলে না নিয়ে পুনরায় তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। পরবর্তী সময়ে বিশেষায়িত ইউনিটের তদন্তে মামলার অভিযোগপত্র ও তদন্তের ফলাফল পুরোটাই বদলে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এমনই এক মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে সময় লেগে যায় ৩০ বছর। ১৯৮৯ সালে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে খুন হন সাগিরা মোর্শেদ নামে এক নারী। এ ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে জানায়, ছিনতাইকারীর গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু বাদী পক্ষের নারাজির ভিত্তিতে অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। পরিবর্তন হন ২৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা। অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে আসে সাগিরা মোর্শেদ ছিনতাইকারীর গুলিতে নন, পারিবারিক দ্বন্দ্বে ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
শুধু মামলা তদন্তেই নয়, পরোয়ানা তামিলের ক্ষেত্রেও ভুল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে। একজনের নাম হাবিবুল্লাহ রাজন, অন্যজন রাজন ভুঁইয়া। দুজনের বাড়িই কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায়। বাবার নামও এক। তবে একজনের বাবা জীবিত, অন্যজনের মৃত। মাদক মামলায় আদালতের পরোয়ানা তামিল করতে গিয়ে পুলিশ হাবিবুল্লাহ রাজনের পরিবর্তে নিরীহ রাজন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। পরে অবশ্য আদালতের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান। পাশাপাশি যে পুলিশ কর্মকর্তার ভুলে এ কাজ হয়েছে, তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, বেশকিছু মামলার ট্রায়ালে আমরা লক্ষ্য করছি থানা পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র যখন পুনঃতদন্তের জন্য বিশেষায়িত কোনো ইউনিটে দেয়া হচ্ছে, সেখান থেকে বিপরীত তথ্যপ্রমাণ উঠে আসছে। এখান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, রুটিন ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা মামলা তদন্তে বা পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে তেমন সময় ও গুরুত্ব দিতে পারছেন না। কারণ, তার প্রধান দায়িত্ব রুটিন ডিউটির মাধ্যমে অপরাধ দমনে রাখা। কিন্তু পিবিআই বা সিআইডির মতো অপরাধ তদন্তে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গাটা হচ্ছে তদন্ত। তাছাড়াও তাদের যেসব প্রশিক্ষণ রয়েছে, তা নেয়ার সুযোগ থানাভিত্তিক পুলিশদের নেই। আবার একইভাবে অপরাধ দমনের জন্য যে দক্ষতা দরকার, সেখানে কিন্তু মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে রয়েছেন। এখন সময় এসেছে ক্রিমিন্যাল জাস্টিস সিস্টেমের রিফর্ম করার।
রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, দিনে ১২ ঘণ্টা ভারী পোশাক পরে শিফট ডিউটি করা লাগে। বেশির ভাগ সময়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাছাড়া কর্মস্থলে খাবার সংকটের পাশাপাশি রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকটও। এসব সমস্যার মধ্য দিয়েই শিফট ডিউটি করে আরো অন্যান্য কাজ করতে হয়।
ওই পুলিশ সদস্য আরো বলেন, সপ্তাহে তিন রাত নাইট ডিউটি করা লাগে। এর বাইরে পুরো সপ্তাহে দিন-রাত মিলিয়ে ৮৪ ঘণ্টা শুধু শিফট ডিউটিই করা লাগে। এর বাইরে বিশেষ ডিউটিও থাকে। এসব শেষ করে মামলার তদন্ত নিয়ে কাজ করতে হয়।
শুধু মামলা তদন্তে ভুল বা ধীরগতি নয়, অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের মান নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। তদন্ত শেষে আদালতে দেয়া পুলিশের দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। পুলিশের কনস্টেবল মো. সহিদুল ইসলামের একমাত্র ছেলে রিয়াজুল ইসলাম মারা যান ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর। গোপালগঞ্জ থানার পুলিশ ও জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে বলে, রিয়াজ নেশা করতে গিয়ে নেশাদ্রব্যের বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশে পাঁচ বছর পর ঘটনাটি আবার তদন্ত করে পুলিশ বলছে, রিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে তারই বন্ধুরা। পরবর্তী তদন্তটি করেছে পুলিশের নতুন একটি তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষে মোট ১৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে তারা। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
পুলিশের দীর্ঘ ডিউটি নিয়ে কথা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা ছাড়াই কর্তব্যের প্রয়োজনে অনেক সময়ই পুলিশ সদস্যদের শিফট ডিউটির বাইরে গিয়েও দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেহেতু পুলিশ একটি সেবামূলক সুশৃঙ্খল বাহিনী, তাই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ বাহিনীর সদস্যরা সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করার মতো মানসিকতা নিয়েই কাজ করে থাকেন।
সূত্র: বণিক বার্তা