গাজীপুর

বেতপণ্যের শতবর্ষী হাট বরমী

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নদীকেন্দ্রিক শতবর্ষের হাট বরমী। শ্রীপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে বানার নদের পাড়ের এই সাপ্তাহিক হাটে ঢুকলেই চোখে পড়বে বেতের তৈরি নানান তৈজসপত্রের পসরা। প্রাচীন বটগাছের পাশে হাতে তৈরি তৈজসের এ হাটের বয়স প্রায় এক শতাব্দী। গাজীপুর ছাড়াও পাশের ময়মনসিংহ অঞ্চলেরও গুরুত্বপূর্ণ হাট এটি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কারিগরেরা তাঁদের তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে সপ্তাহে এক দিন এ বাজারে আসেন।

বুধবার দুপুরের দিকে হাটে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি অস্থায়ী দোকান বসেছে হস্তশিল্প পণ্যের পসরা সাজিয়ে। ত্রিপল টানিয়ে সেখানে চলছে বেচাকেনা। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ কেউ বিক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন। বনিবনা না হলে অন্য দোকানে গিয়ে একই পণ্যের দাম যাচাই করছেন।

হাটে কথা হয় অশীতিপর হজরত আলীর সঙ্গে। জীবনসায়াহ্নে এসেও তিনি হস্তশিল্পের বণিক। এখনো তাঁর ভালো লাগে এ কাজ। জানালেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এই বাজারের নিয়মিত বিক্রেতা। বাজার জমে ১০০ বছরেরও আগে। তাঁর ভাষায়, ‘সংগ্রাম গেছে যত বছর, হের আগে থেইক্কা এই বাজারে এইগুলা বেচি। বাপে বেচতো, দাদাও বেচতো এই হাটে।’ পাশের জেলা নরসিংদী থেকে এসেছেন তিনি। তাঁর পসরায় আছে বাঁশের বেতের হাঁড়ি, খাঁচা, কুলা, ডুলা (শিকারির মাছ রাখার পাত্র), মাছ ধরার চাঁই (মাছ ধরার ফাঁদ), চালুনি, মাথাল, কৃষিপণ্য মাপার দাঁড়িপাল্লা, মাটি কাটার বাঁশের তৈরি হাঁড়িসহ বিভিন্ন পণ্য। এগুলো তিনি নিজেই তৈরি করতে পারতেন। তবে বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর পারেন না। অন্যের কাছ থেকে কিনে এনে বিক্রি করেন। তাঁর ধারণা, এ বাজার গাজীপুর জেলার সবচেয়ে বড় বাঁশ-বেতের কৃষি সরঞ্জামের বাজার।

একই ধরনের পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি জিনিসগুলো নিজেই তৈরি করতে পারেন। তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে এনেই বিক্রি করেন বেশি। তিনি জানান, মৌসুমের সময় (ধান/শস্য কাটার সময়) এ জিনিসগুলোর কদর অনেক বেড়ে যায়। তখন এ বাজারে প্রচুর বিক্রি হয়। আশপাশের জেলা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতা এসে একসঙ্গে অনেক জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যান।

জালাল মিয়া এসেছেন কাপাসিয়া থেকে। বেশ বড়সড় পণ্যের দোকান তাঁর। কৃষকের মাথাল তৈরিতে আছে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। বললেন, ‘এই বাজারে পাতলা (মাথাল) বিক্রি করি ১৫ বছর ধইরা।’ তাঁর কাছে বেশ কয়েকটি মাছ ধরার চাঁই আছে। তিনি বাঁশ কেটে নিজেই তৈরি করেন চাঁই। প্রতিটির আকারভেদে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম পড়ে। মাথালের দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা।

বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে শীতল পাটির আছে বিশ্ব ঐতিহ্য। আর এ বাজারে মেলে খুব ভালো মানের শীতল পাটি। হাটের দক্ষিণ পাশে শীতল পাটি নিয়ে বসেছেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে কথা হয় রঞ্জিত চন্দ্র দেবের সঙ্গে। তিনি নিজের জমিতে শীতল পাটি তৈরির জন্য মুর্তা চাষ করেন। সেগুলো থেকে বেত কেটে রোদে শুকিয়ে তা থেকে তৈরি করেন শীতল পাটি। রঞ্জিত বলেন, গাছ থেকে তিন ধরনের বেত পাওয়া যায়। এই তিন ধরনের বেতে ভিন্ন ভিন্ন মানের পাটি তৈরি হয়। বেতের প্রথম অংশ দিয়ে তৈরি পাটির দাম বেশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ দিয়ে তৈরি পাটির দাম তুলনামূলক কম। তিনি ২০ বছর ধরে এ পাটি তৈরি করেন। আগে এই ব্যবসা করতেন তাঁর বাবা-দাদারা। তাঁদের পরিবারের প্রায় সবাই এ পাটি বানাতে পারেন। পাটি তৈরিতে তাঁর স্ত্রীও সিদ্ধহস্ত। টানা কাজ করলে একেকটি পাটি তৈরি করতে তিন-চার দিন সময় লাগে। প্রতিটি পাটি আকারভেদে খুচরা ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া ৩০০-৪০০ টাকারও পাটি আছে তাঁর কাছে। পাশেই বসেছেন তরুণী চন্দ্র মিত্র। তিনি ১০টি পাটি নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। এ পাটিগুলো সব বিক্রি না হলে কাপাসিয়া বাজারে নিয়ে যাবেন। সেখানেও এসব পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া আরও ছোট ছোট কয়েকটি হাট আছে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে।

শতবর্ষী এ হাট বসে সপ্তাহের প্রতি বুধবার। বাঁশ-বেতের কৃষি ও কারুপণ্যের এ হাটের এক পাশে বসে মাছ ধরার সরঞ্জামের দোকান। বেশ কয়েকটি দোকানে মেলে জাল, বড়শি, মাছ ধরার টোপসহ নানা জিনিস।

 

সূত্র: প্রথম আলো

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button