টাকার খনি কারা হাসপাতাল!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তা গেছেন গাজীপুর জেলা কারাগারের হাসপাতালে। সেখানে বিভিন্ন বেডে থাকা বন্দিদের অসুখ-বিসুখের ধরন, চিকিৎসার কাগজপত্রসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখতে পান মাত্র দুজন বন্দি অসুস্থ। হাসপাতালের বেড়ে আরামে শুয়ে থাকা বাকি ২৮ বন্দিই পুরোপুরি সুস্থ। সুস্থ বন্দিদের কাছে জানতে চাইলেন, কীভাবে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তারা। এ প্রশ্ন থেকেই বেরিয়ে এলো কারা হাসপাতালের অনিয়মের নানা কথা।
কারাগার পরিদর্শন করা কর্মকর্তাদের মতে, কোনো অসুখ-বিসুখের দরকার হয় না, শুধু টাকা হলেই অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে ‘মুক্তি’ মেলে কয়েদিদের। অসুস্থতার ভান করে কারাগার থেকে হাসপাতালে চলে আসেন বন্দিরা। মাসের পর মাস কাটিয়ে দেন হাসপাতালের বিছানায়, সময় কাটান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে জঙ্গি, বড় ব্যবসায়ী থেকে ছোট অপরাধের আসামি যারা টাকা খরচ করছেন, তারাই পাচ্ছেন এ সুবিধা। টাকার বিনিময়ে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে আলোচিত মামলার আসামিদেরও।
আগাম সংবাদ না দিয়ে গত ২৯ অক্টোবর গাজীপুর জেলা কারাগার পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল। কারা হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে এসব ঘটনা উদ্ঘাটন করেন তারা। চট্টগ্রাম কারাগারের জেল সুপার সোহেল রানা বিপুল পরিমাণ অর্থসহ আশুগঞ্জে পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর কারা হাসপাতালের অনিয়ম অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কারাগারে যান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাফটকে নেমেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দেখতে পান যে, সেখানে কর্তব্যরত কারারক্ষী লুৎফর রহমান দূরে ঘোরাফেরা করছেন। ভেতরে ঢুকে তারা সিনিয়র জেল সুপার, জেল সুপার ও ডেপুটি জেল সুপারের খোঁজ করেন। তাদের কাউকেই তখন কারাগারের ভেতরে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারা ছুটিও নেননি, কারাগারের অন্য কাউকে কিছু বলেও যাননি।
পরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হঠাৎ কারা অভ্যন্তরের হাসপাতালে ঢোকেন। সেখানে একজন একজন করে প্রত্যেক বেডে থাকা বন্দিদের রোগের ধরন, কতদিন ধরে হাসপাতালে রয়েছে, কীভাবে হাসপাতালে এসেছে খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে জানতে চান এবং রোগীদের কাগজপত্র যাচাই করেন। তাতে গাজীপুর জেলা কারা হাসপাতালে তখন থাকা ৩০ জন বন্দির মধ্যে মাত্র দুজন অসুস্থ বলে দেখতে পান। বাকি ২৮ জনই সুস্থ। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হাসপাতালের বেডে থাকা কথিত অসুস্থ বন্দিরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
অনুসন্ধানে কর্মকর্তারা জানতে পারেন, প্রত্যেকের কাছে ঘুষ আদায় করে আয়েশে হাসপাতালের বেডে থাকতে দিচ্ছে কারা কর্র্তৃপক্ষ। কারাগারের রান্নাঘরের পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেনসিডিল, বিয়ার, এনার্জি ড্রিংকস, মদের বোতল পড়ে ছিল। রান্নাঘরে রাখা পচা মিষ্টি কুমড়া, আলুর গন্ধ পান সরকারি কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিনিধিদলের এক কর্মকর্তা বলেন, কারা হাসপাতালে যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে। তবে নির্বাচনী কাজে ব্যস্ততার কারণে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। চলতি মাসের মধ্যেই কারা হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভালো হবে বলে আশা করছি।
এ প্রসঙ্গে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কারাগারের হাসপাতালের অনিয়ম দূর করতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। সুস্থ বন্দিরা অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালের সিট বরাদ্দ নেয় বলে অভিযোগ আসে। এগুলো তদন্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল কোনো কারাগারে সরেজমিন গিয়ে অনিয়ম পেলে তারাও ব্যবস্থা নিতে পারেন। কারণ কারা অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই অধীন।
এক কারা কর্মকর্তা জানান, সবকটি কারা হাসপাতালেই অনিয়ম হচ্ছে, তা সত্য। কারাগারের কর্মকর্তারাই এতে জড়িত। এসব অনিয়ম বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।
মুক্তিপ্রাপ্ত এক হাজতি জানান, কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগারে দুই মাস ছিলেন তিনি। দুই কারাগারের আমদানি শাখা (প্রথম রাতে স্থান পাওয়া) হতে শুরু করে ওয়ার্ডে পাঠানো পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে, কখনো স্যাঁতসেঁতে ফ্লোরে ঘুমাতে হয়েছে। হাসপাতালেও একই অবস্থা।
তিনি আরো বলেন, বন্দিদের চিকিৎসা সুবিধার জন্য কারা হাসপাতাল চালু হলেও প্রকৃত রোগীরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল বন্দিরা আরাম-আয়েশের জন্য রোগীর সিট ভাড়া নিয়ে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন। হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ও রক্ষীরা রোগীদের কাছে সিট বিক্রি করে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। আমিও টাকা দিয়ে হাসপাতালের বেডে থেকেছি।
সবকটি কেন্দ্রীয় কারাগারে হাসপাতালে আছে পাঁচটি ওয়ার্ড। ৩নং ওয়ার্ড বাদে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতি সিটের ভাড়া ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা। খাওয়ার জন্য প্রত্যেককে দিতে হয় মাসে ৭ হাজার টাকা, উন্নত পরিবেশে গোসল ও কাপড় ধোয়ার জন্য প্রতি মাসে আরো লাগে ১ হাজার ২০০ টাকা। ৩নং ওয়ার্ডটিতে সুযোগ-সুবিধা আরো বেশি। ভিআইপি বন্দিরাই এই ওয়ার্ডে থাকার সুযোগ পান বেশি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাভারের আলোচিত ধসে পড়া রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাও কাশিমপুর কারাগারের হাসপাতালে বছরখানেক ধরে আরাম-আয়েশেই আছেন। তাছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম সোহেল, ফ্রিডম রাশু, আরমানসহ অন্তত অর্ধশত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি অসুস্থতার ভান করে ঢাকা, গাজীপুর, বরিশালসহ প্রায়ই কারাগারে দিনের পর দিন থাকছেন। বিনিময়ে কারারক্ষীরা মোটা অঙ্কের অর্থ নিচ্ছে। কারাগারেই জটিল রোগে আক্রান্ত বন্দি থাকলেও বছরের পর বছর ঘুরে তারা হাসপাতালে সিট কিংবা চিকিৎসা কোনোটাই পান না। হাসপাতালে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ, পছন্দের ওয়ার্ডে আসন দেওয়া, জামিনের পর মুক্তি, চালান (কারাগার বদল), কারারক্ষীদের সরাসরি মাদক বিক্রি, খাবারে অনিয়ম, বন্দির জমাকৃত অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বড় কারাগারগুলোয় প্রতি মাসে কোটি টাকা আয় হয়।
সূত্র: দেশ রূপান্তর