জাতীয় নির্বাচন ৬ মাস নির্বাচনী পাহারাদার হোন
মিজানুর রহমান খান : ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়ে গেল। এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ বা আপত্তির বিষয়গুলো আমরা জেনেছি। এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষেরও নানা প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু শুধু প্রশ্ন তোলা বা অভিযোগ করলেই কোনো নাগরিক বা দলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। একজন দলীয় বা নির্দলীয় ভোটার কোনো অনিয়মের কারণে সংক্ষুব্ধ হতেই পারেন। ভোটের দিন চলে গেলেই এর প্রতিকার চাওয়ার বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না। ভোটের দিনের যেকোনো দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আপনি আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন। তবে এটা আপনাকে অপরাধ সংঘটনের ৬ মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে চাইতে হবে। এটা কতটা বাস্তবানুগ, সেই প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু আপনি আইনের আশ্রয় নিতে বিমুখ থাকবেন, সেটা যুক্তি নয়। উত্তম বিকল্প তাহলে কী?
তাই সত্যিই কোনো অনিয়ম ঘটলে, তার প্রমাণ সংগ্রহ করুন। ৬ জানুয়ারির মধ্যে ইসি গেজেটে ফল প্রকাশ করবে। এই ফল প্রকাশ মানেই অনেকের ধারণা, কারও প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু আইন তা বলছে না। যাঁরা জয়ী হলেন, তাঁরা সাংসদ পদ হারাতে পারেন। যাঁরা পরাজিত, তাঁদের প্রার্থিতাও ছয় মাসের মধ্যে অবৈধ গণ্য হতে পারে। শুধুই প্রার্থিতা বা সাংসদ পদ নয়, নির্বাচনের দিনের কোনো জালিয়াতির অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে ছয় মাস জেল হতে পারে।
নির্বাচনী ব্যয় ছিল প্রার্থীপ্রতি অনধিক ২৫ লাখ টাকা। এই টাকা একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক থেকে ভাউচার রেখে খরচ করার কথা। ফল গেজেট প্রকাশের পর ৩০ দিনের মধ্যে তাঁরা এটা জমা দেবেন। এ–সংক্রান্ত ব্যয়ের বিবরণীগুলো প্রত্যেক প্রার্থীকেই দিতে হবে। ডিসি অফিসে গিয়ে তা দেখা যাবে। আইন বলেছে, নাগরিকেরা এটা দেখবেন বলে খুলে রাখতে হবে। ১২০ দিন খোলা থাকবে। সুতরাং ভোট দিলেই নাগরিক দায় শেষ হয় না। পাবনা ও বগুড়ায় নির্বাচনী এজেন্ট বের করে দেওয়া, প্রকাশ্যে সিল মারা, ভয়ভীতি দেখানো—এমনকি আগের রাতে ‘৮০ শতাংশ’ ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার মতো অভিযোগ এনেছে বিরোধী দল। নাগরিক হিসেবে কেউ ভোট না দিতে পারলে তার প্রতিকারের চেষ্টা তাঁকেই করতে হবে। আপনার সম্পদ চলে গেলে আপনি তা ফিরে পেতে লড়াই করেন। ভোটও আপনার সম্পদ। আপনার মালিকানার বিষয়।
আপনাকে তাই ভোটের পাহারাদার হতে হবে। এই লড়াই ভোটের দিন সূর্যাস্তের পরে শেষ হয়ে যায় না। আগামী পাঁচ বছরে যেকোনো দিনই নির্বাচিত ব্যক্তিরা নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারেন। এমনকি ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্টসহ পুলিশের কারও অসদাচরণের জন্যও শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
নিয়ম হলো, কিছু অপরাধের বিচার করবেন হাইকোর্টের বিচারকদের সমন্বয়ে নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল। আর কিছুর বিচার হবে নিম্ন আদালতে। তবে সে জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসির অনুমোদন লাগবে। ভোটারদের উচিত কোনো অভিযোগ থাকলে তা লিখিতভাবে ইসির কাছে অভিযোগ করা। এটা সাধারণত আনা হয় না বলে ইসির ওপর কোনো চাপ তৈরি হয় না। সবারই ধারণা, সব প্রতিকার বুঝি ভোটের দিনটা পার করতে পারলেই তামাদি বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সেটা কিন্তু নয়। হাইকোর্ট গোটা নির্বাচন বাতিল করতে পারেন।
আপনারা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল রেকর্ড—এসব অভিযোগের কাজে লাগানো সম্ভব। কারণ, নতুন আইন এটাকে বৈধ করেছে। হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়ে যে কেউ আবেদন করতে পারবেন।
নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারে ১৯০৮ সালের কোড অব সিভিল প্রসিডিউর এবং ১৮৭২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট বা সাক্ষ্য আইন চলবে। অন্যান্য মামলার বিচারের চেয়ে নির্বাচনী বিরোধের বিচারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে দীর্ঘসূত্রতা না ঘটে। এ জন্য আইন বলেছে, হাইকোর্ট বিভাগ যখন বিচার শুরু করবেন, তখন কেবল ন্যায়বিচারের স্বার্থ ব্যতিরেকে এর বিচারকার্য স্থগিত বা মুলতবি করা যাবে না। তবে ন্যায়বিচারের স্বার্থ কী, সেটা বিচারক নিজেই নির্ধারণ করবেন।
নির্বাচনী মামলার ডকুমেন্ট বা নথিপত্র কোনো ক্ষুদ্র কারণে অগ্রহণযোগ্য বলে আদালত বিবেচনা করতে পারবেন না। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণকালে আপনি কাকে ভোট দিয়েছেন, সেই তথ্য প্রকাশে বিচারক আপনাকে বাধ্য করতে পারবেন না। অনেকের ধারণা, রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র বৈধ করেছেন এবং আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, সুতরাং ভোটের পরে কারও প্রার্থী হওয়ার বৈধতার প্রশ্ন আর তোলা যাবে না, সেটি কিন্তু ঠিক নয়। আপিল বিভাগ যেসব প্রশ্ন মীমাংসা করেছেন, সেগুলোর সবটাই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ। আরপিওর ৬৩ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, হাইকোর্ট বিভাগ কোনো নির্বাচনের প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবেন, যদি তিনি দেখেন যে যাঁকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে, তা বৈধভাবে দেওয়া হয়নি।
ভোটের দিনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে উচ্চ স্বরে কথা বলাও নিষেধ ছিল। ঠিক কতগুলো কেন্দ্রে শান্তিভঙ্গ ঘটেছে, তার তালিকা হতে পারে। কোনো বিরক্তি সৃষ্টির অপরাধ প্রমাণ করতে পারলে কারও তিন বছর জেল হতে পারে। এসব বিধান আর কতকাল কেতাবেই থাকবে? কোনো ভোটারকে কোনোভাবে বিরক্ত করা যাবে না। কিন্তু সারা দেশে এভাবে বিরক্ত করার ভূরি ভূরি অভিযোগ আছে। এখানেও তিন বছরের জেলের বিধান আছে। আমরা ১১টি সংসদ নির্বাচন করেছি। অথচ আজ পর্যন্ত এসব ধারায় কোনো একটি মামলা পর্যন্ত হলো না। এটি একটি নাগরিক ব্যর্থতা। আড়াই কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে, তারা যদি এবার বিরক্ত হয়ে থাকে, তবে এই ধারায় অভিযোগ করতে এগিয়ে আসতে পারে।
এসব অভিযোগে অভিযুক্তকে ছয় মাসের নিচে কোনো দণ্ড দিতে আদালতের ক্ষমতাই নেই। এবারে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছিল ইভিএম বিষয়ে। ইভিএম–সংক্রান্ত সফটওয়্যার বা এর কোনো কিছুতে যদি পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে তার জেল সাত বছর। ইভিএম কোথাও কোথাও কাজ করেনি, এখানেও অনিয়ম ঘটার কথা উঠেছে।
বেড়ায় আবু সাইয়িদ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কর্তৃক নির্বাচনী এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। আমাকে তিনি বেলা ১১টাতেই বলেছিলেন, তিনি সংবিধানের ১২৩ খ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদ ভেঙে ৯০ দিনের মধ্যে নতুন ভোট চান। কোনো নির্বাচনী এজেন্টকে বা প্রার্থীকে কোনো দলের কর্মী বা নির্বাচনী কর্মকর্তা ভোটদানে বাধা দিলে তার শাস্তি সাত বছর জেল। কমপক্ষে ছয় মাস। রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ভোট গ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তা যদি ভোটের গোপনীয়তা নষ্ট করেন, তাহলে তাঁর পাঁচ বছর এবং কমপক্ষে তাঁর জেল হবে এক বছর। আরপিওর ৮৪ অনুচ্ছেদে পুলিশের জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছে। পুলিশকে যদি কোথাও কাউকে ভোট দিতে উৎসাহিত কিংবা বিরত রাখতে তৎপর হতে দেখা যায়, তাহলে ওই পুলিশের পাঁচ বছর জেল। কমপক্ষে এক বছর জেল হবেই।
তবে এখানেই ইসির স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পুলিশ ও ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা জানেন, ইসির পূর্বানুমতি ছাড়া ভোটাররা মামলা করতে পারবেন না। কিন্তু ভোটারদের তাতে ভড়কে গেলে চলবে না। সারা দেশ থেকে অনুমতির জন্য আবেদন পেলে নির্বাচন কমিশনকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসি নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে কারও প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। আইন বলেছে, বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ন্যায়সংগত ও নিরপেক্ষভাবে এবং আইন অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে তারা সক্ষম থাকবে। কোনো ব্যালট পেপার বাতিল বা গ্রহণসহ কোনো কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত কোনো আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পারবে। আইন আরও বলেছে, ‘প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আদেশ’ দিতেও তারা পারবে। ইসি চাইলে এখনো তদন্ত করতে পারে। আইনে পথ খোলা। নির্বাচন জাতির জীবনে আরও আসবে। মোট ভোটারের অর্ধেক তখন তরুণ হবে। আমরা যা পারিনি, তারা যাতে সেটা পারে, সেই পথ খুলে দিই। আইনে এসব যে আছে, তা তাদের জানিয়ে রাখা দরকার। এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করি না। এই প্রক্রিয়ায় যদি একটিতেও ফল পাওয়া যায়, সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ভোটের দিনে ভিজিল্যান্স টিম, অবজারভেশন টিম, মনিটরিং টিম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেল সক্রিয় ছিল। সবটার প্রধান ডিসি ছিলেন। তাদের জবাবদিহিটা নীরবে নাগরিকেরা করতে পারে। এই কমিটিগুলো অকার্যকর থেকেছে বলে ২০২৩ ও ২০২৮ সালেও থাকবে? একটি কমিটিতে ‘বেসরকারি পর্যায়ের দলনিরপেক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ’ অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু থাকেনি বলে কোনো দিন থাকবে না? সে জন্যই শুরুটা দরকার।
মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com