কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যার ৩ একর জমি ভরসা গ্রুপের দখলে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জ উপজেলার মূলগাঁও দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। ওই এলাকায় কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল সড়কের পাশে স্থাপিত একটি সরকারি কারখানা কিনে নেয় ভরসা গ্রুপ। এর মধ্য দিয়ে সরকারের কাছ থেকে ১৫ একর জমি কিনলেও পরবর্তী সময়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তিন একর জমি দখল করে নিয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নদীর জমি দখলের এ অভিযোগ তোলা হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যমতে, ভরসা গ্রুপের দখল করা এ জমির মধ্যে দুই একরের বেশি রয়েছে নদীর শিকস্তি জমি। বাকি এক একর নদীর জমি। নদীর এই জমিতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি অ্যাঙ্গেল শেড, সাতটি সেমিপাকা বিল্ডিং, তিনটি টিনশেড ঘর ও একটি ইটিপি প্লান্ট। এতে কমে গেছে নদীর প্রশস্ততা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাট শিল্পের বিকাশে পাকিস্তান আমলে কালীগঞ্জের মূলগাঁও মৌজায় একটি জুট মিল স্থাপন করে তত্কালীন সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই মিলের নাম দেয়া হয় সোনার বাংলা জুট মিল। প্রায় ১৫ একর জমির ওপর নির্মিত জুট মিলটি ১৯৯৭ সালে কিনে নেয় ভরসা গ্রুপ। সেখানে প্রথমে তারা ‘আর কে জুট মিল’ নামের একটি কারখানা স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে জুট মিলের পাশাপাশি শীতলক্ষ্যার পাড়ে ‘জে টি এ ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড’ ও ‘ভরসা এগ্রোকেমিক্যাল লিমিটেড’ নামে আরো দুটি কারখানা স্থাপন করে গ্রুপটি। বাড়তি দুটি কারখানার জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত জমির। সেই চাহিদা মেটাতেই নদীর তিন একরেরও বেশি জমি নিজেদের দখলে নেয় শিল্প গ্রুপটি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যা নদীর গাজীপুর অংশের এক পাশে রয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলা, অন্য পাশে নরসিংদীর পলাশ উপজেলা। কালীগঞ্জ উপজেলার মূলগাঁও অংশে নদীর জমি দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও ইটিপি প্লান্ট স্থাপন করেছে ভরসা গ্রুপ। দখলের পাশাপাশি নদী দূষণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কারখানাটির এগ্রোফুড কেমিক্যালের বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে নদীতে। এতে বিপন্ন হতে বসেছে নদীর মাছ ও জীববৈচিত্র্য।
নদী দখল ও দূষণের বিষয়টি জানতে কথা হয় ভরসা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফের সঙ্গে। অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিকানা ভরসা গ্রুপ পেয়েছে। এখানে নদীর কোনো জায়গা দখল হয়নি। ভূমি অফিসের প্রতিবেদনে নদী দখলকারী ভরসা গ্রুপের নাম থাকার বিষয়টিও ভুল বোঝাবুঝি বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
তবে কালীগঞ্জের সহকরী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জুবের আলম বলেন, অবশ্যই ভরসা গ্রুপ নদীর জমি দখল করেছে। তারা ১৫ একর জমির মালিকানা ক্রয়সূত্রে পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নদীর পাড়েও তারা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছে। আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, নদীর পাড়ের ১০ থেকে ৩০ মিটার জায়গা ছেড়ে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু তারা সেটি করেনি। আমরা নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএকে বিষয়টি জানিয়েছি। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদীকে দখলমুক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
শীতলক্ষ্যা নদীটি বয়ে গেছে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে। ১০৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীর গড় প্রশস্ততা ছিল ২২৮ মিটার। একসময়ের প্রমত্তা এ নদীটি এখন দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। অনেক স্থানেই হারিয়ে গেছে নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। স্থানীয় দখলদারদের পাশাপাশি নদীর জমি দখল করেছে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানাও। কারখানার বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে নদীর পানি।
বংশপরম্পরায় শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ খেয়াঘাটে নৌকা চালান আফজাল হোসেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ মাঝি জানান, দাদা ও বাবার পর তিনি শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌকা চালাচ্ছেন। আগে নৌকা চালানোর পাশাপাশি নদী থেকে নানা পদের মাছ ধরতেন তারা। এখন আর নদীতে কোনো মাছ পাওয়া যায় না। শীতলক্ষ্যার মূলগাঁও ও চরমিরপুর অংশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশের পানি শিল্পবর্জ্যের দূষণে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নদীর পানির ওপর ভাসছে রাসায়নিকের স্তর।
নদী রক্ষায় স্থানীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল। সংগঠনের সভাপতি ও নদী গবেষক মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে ঘোড়াশাল ব্রিজ পর্যন্ত অংশটি দখল ও দূষণে বিপন্নপ্রায়। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানও নিয়মিত নদী দখল ও দূষণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ভরসা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি তাদের নির্ধারিত জায়গার বাইরে এসে নদীর জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করেছে এবং তাদের দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে।
তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীটি দখল ও দূষণ থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের বেশকিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথমেই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীর পাড়ঘেঁষে একটি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে, যাতে পুনরায় প্রতিষ্ঠানগুলো নদীর জমি দখলে না নিতে পারে। পাশাপাশি নদীর অববাহিকার যেসব পানি কারখানাগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের পর পরিশোধন ছাড়াই আবার নদীতে ছেড়ে দিচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নদী রক্ষার জন্য নিয়মিত অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ সংক্রান্ত আরো জানতে…….
কালীগঞ্জে চার কোম্পানির দখলে ‘শীতলক্ষ্যার ১৫ একর জমি’, উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ!
সূত্র: বণিক বার্তা