গাজীপুর

গাজীপুরে টেন পার্সেন্ট ছাড়া অধিগ্রহণের টাকা মেলে না

সিসি ক্যামেরা এড়াতে অর্থ লেনদেন হয় টয়লেটে, যার ভাগ যায় বড় কর্মকর্তাদের পকেটে * টাকা না দিলে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে ফাইল আটকে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণ পেতে ‘টেন পার্সেন্ট’ ঘুষ দিতে হচ্ছে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এ হারে আগাম ঘুষের টাকা না দিলে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অর্থ ছাড়ের ফাইল আটকে যায়। চাহিদা মাফিক টাকা না দিলে নানা সমস্যার কথা বলে ক্ষতিপূরণের টাকা ছাড় না করার হুমকিও দেয়া হয় ক্ষতিগ্রস্তদের। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ নিচ্ছেন। তবে সিসি ক্যামেরা এড়াতে ঘুষের টাকা লেনদেন হয় ডিসি অফিসের টয়লেটে। যার ভাগ যায় বড় কর্মকর্তাদের পকেটে। আবার আগাম ঘুষ দিয়েও এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি অনেকে। এভাবে জমি অধিগ্রহণে ঘুষের ফাঁদ পাতার চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

১৪ জানুয়ারি রোববার যুগান্তর- পত্রিকায় প্রকাশিত ‘টেন পার্সেন্ট ছাড়া অধিগ্রহণের টাকা মেলে না’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে বিভিন্ন পর্যায়ে দালালরা সক্রিয় থাকলেও ঘুষের টাকা নেয়ার সময় কর্মতকর্তারা তাদের ওপর ভরসা করেন না। তাই নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে অগ্রীম ঘুষ গ্রহণ করেন।

ক্ষতিপূরণ পেতে নানা হয়রানির অভিজ্ঞতার এমনই বর্ণনা দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কিংবা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন এমন অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। যদি পরে অধিগ্রহণের টাকা না পান এ ভয়ে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তবে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড সংরক্ষিত আছে।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গাজীপুরের ডিসি কার্যালয়ে অধিগ্রহণ শাখার চারজন সার্ভেয়ার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা গ্রহণ করেন। পরে ঘুষের টাকা অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো আবুল বাশার, অধিগ্রহণ শাখার দায়িত্বে থাকা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরেট (আরডিসি) শরিফুল ইসলাম এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি-রাজস্ব) মাহমুদ হাসানের কাছে চলে যায়।

সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে এডিসি-রাজস্বের স্বাক্ষর ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তরা অর্থ পান না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দায় ডিসি এড়াতে পারেন না।

ডিসি অফিসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় অবস্থিত সাফারি পার্কের আয়তন ৩ হাজার ৬৯০ একর। এর মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ৫৫০ একর। যার ৪০০ একর এরই মধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকি জমির অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটি এখনও চলমান।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘুষের টাকার জন্য ডিসি অফিসের চারজন সার্ভেয়ার ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ চারজন সার্ভেয়ারে মধ্যে বেলাল হোসেন সবচেয়ে সিনিয়র।

তিনি ১২ বছর ধরে অধিগ্রহণ শাখায় কাজ করছেন। অন্য তিনজন হলেন- ওমর ফারুক, জাকির হোসেন ও মনিরুল ইসলাম। তারাই ক্ষতিপূরণের টাকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দাবি করেন। কেউ অগ্রীম এ টাকা দিতে রাজি না হলে ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে দেয়ার হুমকি দেন তারা। এমনকি পুনরায় সার্ভে করে ভুয়া প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। যেটি হলে তারা আর ক্ষতিপূরণ পাবেন না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ঢালাও অনেক অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ সরাসরি অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ডিসি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সার্ভেয়াররা টাকা নেন- এমন অভিযোগের বিষয়ে অধিগ্রহণের দায়িত্বে থাকা আরডিসি শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। সার্ভেয়াররা হুমকি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন এমন অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার বেলাল হোসেন ঘুষ নেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সাফারি পার্কের অধিগ্রহণের বিষয়ে এখন তেমন ফাইল নেই। এগুলোর অধিকাংশই ২০১৪-১৫ সালে শেষ হয়ে গেছে।’ ওই সময় ঘুষ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী বলেন? কেন ঘুষ নেব। অফিসে এলে কাগজপত্র দেখালে আপনি বুঝবেন।’

মাওনা ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডিসি কার্যালয়ে ১০ শতাংশ ঘুষ না দিয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া অসম্ভব। এমন একজনও আমি পাইনি যারা ১০ শতাংশ ঘুষ না নিয়ে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অনেকেই আছেন যারা ২০ শতাংশ ঘুষও দিয়েছেন।’ ২ সপ্তাহ আগে মাওনার ইন্দোপুর গ্রামের একজনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তি ডিসি অফিসে ১০ শতাংশ ঘুষ দিয়েছেন। তবে তার নাম পত্রিকায় প্রকাশ পেলে তিনি আর ক্ষতিপূরণ পাবেন না। এজন্য নামটা প্রকাশ করছি না।’

এরপর ভুক্তভোগী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ বাবদ আমি ২৫ লাখ টাকা পাব। নির্বিঘ্নে অর্থ ছাড় নিশ্চিত করতে ১০ শতাংশ হিসাবে আড়াই লাখ টাকা ডিসি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে দিয়েছি। এখন বিষয়টি পত্রিকায় এলে আমি ক্ষতিপূরণের টাকা আর পাব না।’

সাফারি পার্কের তিন নম্বর গেট এলাকার শফিকুল ইসলাম এবং সাদেক মিয়া একই ধরনের তথ্য দেন। সাদেক মিয়া বলেন, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন কেউ ক্ষতিপূরণের ১০ শতাংশ টাকা অগ্রীম ঘুষ না দিয়ে টাকা পেয়েছেন কিনা?

ঘুষের টাকা লেনদেন হয় টয়লেটে : ভুক্তভোগীরা জানান, ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় করতে ঘুষের টাকা লেনদেন হয় টয়লেটে। মূলত সিসি ক্যামেরা থেকে নিজেদের আড়াল করতে এভাবে ঘুষ নেয়া হয়। দুপুর ২টার আগে তারা ঘুষ নেন না। দুপুরের পর অফিস ফাঁকা হলে অধিগ্রহণ শাখায় ক্ষতিগ্রস্তদের আসতে বলা হয়।

জেলার শ্রীপুরের মাওনার ইন্দ্রপুর গ্রামের তিনজন ক্ষতিগ্রস্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ২ বছর আগে টয়লেটের ভেতরে চার লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও টাকা পাননি। তবে ডিসি অফিস থেকে আশ্বাস মিলেছে, শিগগিরই তারা ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়ে যাবেন।

সাফারি পার্কের এক নম্বর গেট এলাকার ইন্দ্রপুর গ্রামের তিনজন ক্ষতিগ্রস্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে দুই লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ২০ লাখ টাকা পেয়েছেন। তিনিও অধিগ্রহণের টাকা টয়লেটে গিয়ে লেনদেন করেছেন। আরও কিছু জমির সমস্যা থাকার কারণে এখনও টাকা পাননি। এ নিয়ে দফায় দফায় ডিসি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের তিনি টাকা দিয়েছেন।

ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-ময়মিনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর সদরের বাঘের বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে সাফারি পার্কটির অবস্থান। ১৯৭৪ সালে প্রাকৃতিক পরিবেশে পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে চম্পা বন বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা প্রদানসহ ব্যক্তিগত তহবিল থেকে চেক প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে সাফারি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরপর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button