আলোচিত

বিদেশ পাঠানোর নামে লামিয়া ওভারসিজের প্রতারণা, নিঃস্ব হাজার মানুষ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠান লামিয়া ওভারসিজের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অন্তত এক হাজার মানুষ। ভু্ক্তভোগী দরিদ্র এসব মানুষের দাবি, তাদের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে পৌনে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে পাঠানোর নাম করে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৪ জুন লামিয়ার লাইসেন্স (নম্বর-১৩২৯) বাতিল করা হয়। এরপরও প্রতারণা বন্ধ হয়নি। বিদেশ পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ওয়েবসাইটে লাইসেন্স বাতিল হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম আছে লামিয়া। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা রাজধানীর ১৭, পূর্ব রামপুরা, ডিআইটি রোড।

লাইসেন্স বাতিল হওয়া প্রতিষ্ঠান প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে কিনা, সে ব্যাপারে তদারকি হয় বলে জানান বিএমইটি’র পরিচালক (কর্মসংস্থান) ডি এম আতিকুর রহমান। তবে লামিয়ার কার্যালয় ঘুরে ও একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে বিএমইটি পরিচালকের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লামিয়া ওভারসিজ এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের পথে বসিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লামিয়ার লাইসেন্স বাতিল করলেও ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা আদায়ে কোনও উদ্যোগ নেয়নি বিএমইটি। লামিয়ার মালিক সফিকুর রহমান ওরফে ইব্রাহীমও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও এ নিয়ে বিএমইটিতে তদন্ত ও শুনানি চলছে।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, লামিয়ার ম্যানেজার শাহনাজ পারভীন ওরফে সানুও প্রতারণা ও জালিয়াতির অন্যতম হোতা।

লামিয়ার স্বত্বাধিকারী সফিকুরের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করে। অফিসে তার সাক্ষাৎ পাওয়া না গেলেও মুঠোফোনে কথা হয়। বিএমইটিতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হওয়ার কথা স্বীকার করার পরও উল্টো তিনি দাবি করেন, লাইসেন্স বাতিল হওয়ার তথ্য সঠিক নয়। ৫ হাজার লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন কিছু না। কে কী অভিযোগ করলো তাতে কিছু যায় আসে না।’

লামিয়ার প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে আছেন বিএমইটি’র সহকারী পরিচালক (কর্মসংস্থান) সিলভী ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘বাতিল হওয়া লাইসেন্স দিয়ে কাউকে বৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি কেউ পাঠায় তাহলে অবৈধভাবেই পাঠাচ্ছে।’

পাবনার সাথিয়া থানার হলুদঘর গ্রামের হাসান আলী জানান, কাতার বিমানবন্দরে ক্লিনারের কাজ দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা নিয়েছে লামিয়া। গত বছরের ২ এপ্রিল ১৪ হাজার টাকা, ১৭ এপ্রিল ৩০ হাজার টাকা, ২৬ এপ্রিল ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং ২৯ এপ্রিল ৯৬ হাজার টাকা জমা দেন তিনি। টাকা জমা দেওয়ার পর রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

হাসান বলেন, ‘সামান্য ৩ শতক জমি ছিল। বিক্রি করেছি। সুদে টাকা নিয়েছি, আত্মীয়দের কাছ থেকে দেনা করেছি। সব টাকাই লামিয়ার মালিক সফিকুরকে দিয়েছি। তারপরও বিদেশ যেতে পারিনি। গ্রামের বাড়িতেও ফিরতে পারি না। পাওনাদাররা থানা-পুলিশ করেছে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকায় থাকি, কাজ নেই, থাকার জায়গা নেই। পথে বসে গেছি আমি।’

তিনি বলেন, ‘বিএমইটিতে শুনানি হয়েছে। শুনানির পর লামিয়ার লোকজন মারধর করেছে আমাকে। লাশ ফেলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছে।’ বিএমইটি কর্মকর্তাদের সামনেই এসব ঘটেছে দাবি করে হাসান বলেন, “বিএমইটি আমাকে সমর্থন না করে বলেছে, ‘আলোচনা করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন’।”

‘আমার সঙ্গে কেউ নেই’ বলে আক্ষেপ করেন হাসান।

মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে ক্লিনারের চাকরি দেওয়ার কথা বলে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার ছত্রভোগ গ্রামের সহিদুল ইসলামের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়েছে লামিয়া। সহিদুল জানান, গত বছরের ৭ মার্চ ১০ হাজার টাকা, ৭ এপ্রিল ১০ হাজার টাকা, ১৫ এপ্রিল ৩০ হাজার টাকা, ১৭ এপ্রিল ৫০ হাজার টাকা জমা দেন তিনি। এই টাকা জমা দেওয়ার পর রসিদ দেওয়া হয়। তবে এককালীন জমা নেওয়া ১ লাখ টাকার কোনও রসিদ দেওয়া হয়নি।

সহিদুল বলেন, ‘টাকা জমা নেওয়ার পর লামিয়ার সফিকুর জানায়, মালয়েশিয়া নয়, সুদান পাঠানো হবে তাকে। পরে বলে, কাতারে গেলে ভালো হবে। তারপরে বলে, তাঞ্জানিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাসপোর্টের সঙ্গে কিছু কাগজপত্র দিয়ে ঢাকায় বিমানবন্দরে যেতে বলে। সেখানে গেলে কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে বের করে দেওয়া হয়।’

সহিদুল আরও বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে ফেরার পরই লামিয়ার কার্যালয়ে যাই। সেখানে মারধর করে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয় আমাকে।’

তিনি বলেন, ‘টাকা ফেরত চাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহেই একবার লামিয়ার কার্যালয়ে যেতে থাকি। একপর্যায়ে তারা ৪০ হাজার টাকার একটি চেক দেয়। প্রাইম ব্যাংক রামপুরা শাখায় লামিয়ার ব্যাংক হিসাবের ওই চেক নিয়ে ব্যাংকে গেলে জানানো হয় টাকা নেই।’

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ থানার চন্ডীপুর গ্রামের সুলতান মানিক জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ক্লিনার হিসেবে কাজ দেওয়ার নাম করে তার কাছ থেকে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নিয়েছে লামিয়া। ২০১৭ সালে ২৪ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৯ হাজার টাকা নেওয়া হয়। ইসলামী ব্যাংক, খিলগাঁও শাখায় লামিয়ার মালিক সফিকুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে ওই টাকা পাঠান সুলতান। গত বছরে ১২ ফেব্রুয়ারি একই ব্যাংক হিসাবে আরও ৫০ হাজার টাকা পাঠান তিনি। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৯ হাজার টাকা, ১১ এপ্রিল ৩০ হাজার টাকা, ২১ এপ্রিল ১৮ হাজার টাকা এবং ২৩ এপ্রিল ৯০ হাজার লামিয়ায় জমা দেন তিনি। প্রতিবারই টাকা আদায়ের রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সুলতান সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা জমা দেন গত বছরের ১৫ এপ্রিল। অগ্রণী ব্যাংক, রামপুরা শাখায় সফিকুরের ব্যাংক হিসাবে দেড় লাখ টাকা পাঠান তিনি।

পেশায় দিনমজুর সুলতান মানিক জানান, মাত্র ৫ শতক জায়গা ছিল। সেখানেই বাড়ির ভিটে আর সামান্য সবজির আবাদ হতো। জমি বিক্রির পাশাপাশি সুদেও টাকা নিয়েছিলেন তিনি।

বিদেশে যেতে না পেরে ঋণের কারণে সুলতান এখন এলাকায় যেতে পারেন না, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। প্রথমে তাকে কাতার, পরে তানজানিয়া ও সুদানে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিল লামিয়া।

লিকু বড়ুয়া ও মরণ চন্দ্র দেব নামে আরও দুজন জানান, বিদেশ যাওয়ার জন্য লামিয়ায় টাকা জমা দিয়েছেন তারা। কিন্তু বিদেশে যেতে পারেননি।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button