গাজীপুর

স্বৈরশাসকের সন্ত্রাসীদের হামলায় শহীদ হয়েছিলেন ভাওয়াল বীর ময়েজউদ্দিন আহমেদ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিন আহমেদের জন্ম।

কালীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৫০ সালে আইএ, ১৯৫৩ সালে অনার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাবি) ও ১৯৫৫ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে (ঢাবি) থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসা। ১৯৬২-৬৩ সালে শহীদ ময়েজউদ্দিন ঢাকা পৌরসভার অধীনে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্রী (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার পরে এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক সহযোগিতা করেন।

১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হলে শহীদ ময়েজউদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’ এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ শহীদ ময়েজউদ্দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- ‘৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা দিলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি ছিলাম।

সেদিনই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তথাকথিত আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর আমরা যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছিলাম, তার পুরোভাগে ছিলেন ময়েজউদ্দিন ভাই।’

শহীদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সবকিছু ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল।

খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করেন কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে।

সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভুটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেন- ‘কোনো ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোনো মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোনো নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই উঠে না।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেন- ‘খন্দকার মোশতাক অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোনো নেতৃত্ব মানি না। সে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ তার কোনো নেতৃত্ব মানতে পারে না।’

ময়েজউদ্দিন ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএবি’র মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ওচচঋ সহ ওঙজ-এর সদস্য ছিলেন। জবীবড়-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, ’৮০-এর দশকেই এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

তখনই তিনি কালীগঞ্জে নিজ জায়গায় ৩টি মাতৃসদন স্থাপন করে গেছেন। ঐ একই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া শহীদ ময়েজউদ্দিন বহুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবক হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে সভা-সেমিনার এবং সম্মেলনে যোগদান করেছেন তিনি।

১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে।

ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণআন্দোলনে রূপ নেয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজধানীর রাজপথ থেকে কালীগঞ্জের রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জে সামরিক শাসকের দোসররা ততদিনে উপলব্ধি করতে থাকে যে, ময়েজউদ্দিনের উপস্থিতিতে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কালীগঞ্জের ক্ষমতায় আসার জন্য সামরিক শাসকের সঙ্গে ময়েজউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য ময়েজউদ্দিন নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। দেশব্যাপী ২২ দল আহূত হরতাল চলছে।

কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আর তখনই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদতবরণ করেন। কালীগঞ্জের রাজপথ তার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের এই হত্যাকাণ্ডের খবর সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশে তার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়।

কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার রচিত গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’-এ লিখেছেন ‘ময়েজউদ্দিন, তিতাস, রমিজ, বসুনিয়া, চুন্নু এমনই হাজার আত্মাহুতির প্রয়োজন হল গণতন্ত্রের জন্য অধিকারের লড়াইয়ে।’ আজ ৩৫তম শাহাদতবার্ষিকীতে শহীদ ময়েজউদ্দিনসহ সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

 

মো. আমজাদ খান : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button